শিবদাস ঘোষ

ভারতীয় রাজনীতিবিদ

শিবদাস ঘোষ (১৯২৩ – ৫ আগস্ট, ১৯৭৬) হলেন ভারতের একজন মার্কসবাদী দার্শনিক ও চিন্তানায়ক। তিনি ভারতের সাম্যবাদী দল সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অফ ইন্ডিয়া (এসইউসিআই)-এর প্রতিষ্ঠাতা-সাধারণ সম্পাদক। তিনি ভারতের বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ করে মার্কসবাদী দর্শনকে এদেশের মাটিতে প্রয়োগ করে কীভাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পূর্ণ করা যায়, তার পথনির্দেশ করেন।

শিবদাস ঘোষ
  • ভোটের মারফত হাজারবার গভর্নমেন্ট পাল্টে বা আক্ষরিক অর্থে আইনকানুন সংশোধন করার চেষ্টা করার মধ্য দিয়ে জনসাধারণের পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদী শোষণব্যবস্থা থেকে মুক্তি অর্জন অসম্ভব। এই মুক্তি অর্জনের একমাত্র পথ, জনসাধারণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোকে সঠিক বিপ্লবী কায়দায় পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে জনসাধারণের অমোঘ বিপ্লবী সংঘশক্তি গড়ে তোলা এবং বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণীর দলের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা। এ ছাড়া জনসাধারণের মুক্তির আর কোনও দ্বিতীয় রাস্তা নেই।
    • ১৫ই আগস্টের স্বাধীনতা ও গণমুক্তির সমস্যা।
  • “... আমি মনে করি মার্কসবাদী দর্শন আয়ত্ত্ব করতে না পারলে এবং এর সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান ও উপলব্ধি না জন্মালে আজকের দিনে শোষিত মানুষ বর্তমান দুনিয়ার নানাবিধ সমস্যা ও সংকটের চরিত্র সম্পর্কে যথার্থ ধারণা গড়ে তুলতে সক্ষম হবে না এবং নানাবিধ অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় ও বিভিন্ন সমস্যার হাত থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবে না।”
    • (মার্কসবাদ ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের কয়েকটি দিক)
  • শুধু বিপ্লব চাই— এটা কোনও বিপ্লবী চেতনা নয়। তাই শ্রমিক শ্রেণী, সর্বহারার কথা আমি চিন্তা করি— এটাও কোনও সর্বহারা শ্রেণীচেতনা নয়। সঠিক বিপ্লবী চেতনা হল, সঠিক সর্বহারা শ্রেণীচেতনা, আর সঠিক সর্বহারা শ্রেণীচেতনা হল সঠিক পার্টিচেতনা— অর্থাৎ আপনারা সঠিক বিপ্লবী পার্টি চিনতে পেরেছেন কি না।
  • মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ হচ্ছে একমাত্র বিপ্লবী তত্ত্ব, যা আজকের যুগে সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক ও সর্বশ্রেষ্ঠ মতবাদ বা ভাবাদর্শ এবং যা বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের পঙ্গুতা থেকে মানুষকে মুক্ত করে একটা নতুন শোষণহীন শ্রেণিহীন উন্নততর সমাজব্যবস্থার জন্ম দিতে সক্ষম।
    • কেন ভারতবর্ষের মাটিতে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) একমাত্র সাম্যবাদী দল
  • জীবনে মর্যাদা পাওয়া এক কথা; আর ভাল খাবার, ভাল পোশাক-পরিচ্ছদ, শাড়ি-গাড়ি পাওয়া আর এক কথা। এই দুইয়ের মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য। আপনাদের বুঝতে হবে, মর্যাদা হারিয়ে কোনও কিছু পাওয়ার মধ্যে মনুষ্যত্ব নেই। খাওয়া-পরা, সুখ-সম্পদ, যৌন জীবন, ভালোবাসা, স্নেহ-প্রীতি-মমতা, সবই মানুষের জীবনে দরকার। কিন্তু মর্যাদা হারিয়ে যিনি এগুলো পেলেন, মানুষ হিসেবে তাঁর আর রইল কী?
    • নারীমুক্তি প্রসঙ্গে
  • বাস্তবে জ্ঞানজগতকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনুসন্ধান করেছে সর্বযুগে শোষিত সম্প্রদায় তাদের বাঁচার তাগিদেই। কারণ যুগে যুগে শোষিতশ্রেণির মুক্তির প্রশ্নটি সমাজের ক্রমবিকাশ ও সমাজবিপ্লবের প্রশ্নটির সাথে জড়িয়ে থাকে বলেই সত্য জানবার সত্যিকারের প্রয়োজন শোষিতশ্রেণির। আর শোষকশ্রেণির সত্যকে চাপা দেওয়াই কাজ।
    • সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ও বেকার সমস্যার সমাধান কোন পথে
  • কমরেডস, মনে রাখবেন, শুধুমাত্র আদর্শের জন্য শুরুতেই যাঁরা জীবন দিতে এগিয়ে আসেন তাঁরা কোনওদিনই সংখ্যায় বেশি থাকেন না৷ তাঁরা সব সময়েই মুষ্টিমেয়। তাঁরা প্রাণবন্ত ছাত্র-যুবক। প্রতিটি দেশে সমাজ বিকাশের প্রতিটি দেশে সমাজ বিকাশের প্রতিটি স্তরে এই ছাত্র-যুবরাই বিপ্লবী আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসেন, পরিপূর্ণ নিষ্ঠা নিয়ে জনগণের কাছে যান, হাজার হাজার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন, সংগঠিত করেন, জনগণের রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দিতে সাহায্য করেন। এরপরই সময় আসে গণঅভ্যুত্থানের, আর তাকেই আমরা বলি বিপ্লব।
  • মানুষের গুনাবলী আকাশ থেকে পড়ে না- সেগুলো একটা সংগ্রামের ফল।...সামাজিক যে পরিবেশের মধ্যে মানুষ জন্ম নেয়, সেই পরিবেশের সঙ্গে ব্যক্তিসত্তার নিয়ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত ঘটে। তাই তার পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে নিয়ত সংগ্রাম করেই মানুষ বেঁচে থাকে এবং গড়ে ওঠে। পরিবেশের সাথে এই যে নিয়ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে, সেখানে একজন মানুষ কেমন করে, কীভাবে সংগ্রাম করে, কোন্ আদর্শ নীতি ও কোন দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত হয়ে কতটা যোগ্যতার সঙ্গে সে তার সংগ্রাম পরিচালনা করতে সক্ষম হয়, তারই উপর নির্ভর করে সেই মানুষটি জীবনে কেমন রূপ নিয়ে গড়ে উঠবে। তাই প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব, ক্ষমতা এগুলো হচ্ছে এক একটি বিশেষ ধরনের সংগ্রামের ফল।
  • কোন আদর্শের আসল পরিচয় বা মর্মবস্তু নিহিত থাকে তার সংস্কৃতিগত, নীতিগত এবং রুচীগত মানের মধ্যে।...কোন আদর্শ বড় হলেই তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায় না,যদি সেই আদর্শকে রূপায়িত করবে যে মানুষগুলো তারা সেই আদর্শকে রূপায়িত করবার মত বড় মানুষ এবং উন্নত চরিত্রের না হয়।
  • আমাদের নতুন আদর্শ চাই। সমাজ একটি নতুন আদর্শ জন্ম দেওয়ার যন্ত্রণায় কাঁপছে। কি সেই আদর্শ, ... তা হল সমাজতন্ত্রবাদের আদর্শ... সর্বহারা বিপ্লবের আদর্শ, পুঁজিবাদ বিরোধী বিপ্লবের আদর্শ। এই আদর্শে যদি দেশের মানুষকে আমরা উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করতে পারি, সংগ্রামকে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে দেখব, আবার দেশের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
  • একটি জাতি, খেতে না পেয়েও উঠে দাঁড়ায়, না খেয়েও সে লড়ে, যদি মনুষ্যত্ব থাকে। কিন্তু, ফ্যাসিবাদ গড়ে উঠলে মানুষ বলে দেশে আর কেউ থাকবে কারণ, মানুষ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সে বাধা সৃষ্টি করে।
  • ভারতবর্ষে পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কও কাঠামো বজায় রেখেই দেশের সম্পদ এবং উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি করা যাবে এবং তার দ্বারা দেশের মানুষের সমস্ত দুঃখ দুর্দশা দূর হয়ে যাবে – একথা যারা বলে...হয় তারা কিছুই জানে না, আর না হয় শয়তান।
  • আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ যদি শিখতেই হয়, বিপ্লবী তত্ত্ব যদি আয়ত্ত করতেই হয়, তাহলে তেমন নেতা এবং তেমন দলের কাছ থেকেই শিখবেন যাদের কর্মী ও নেতাদের জীবনটাও বিপ্লবীর মত।
  • সমাজ পাল্টাবার একটা ঐতিহাসিক ও বিজ্ঞানসম্মত রাস্তা আছে। এই রাস্তাটার হদিস প্রথম মানুষকে দিয়েছে মার্কসবাদ।...মার্কসবাদ-লেনিনবাদই মানুষকে বুঝতে শেখায় তার জীবনের সত্যিকারের সমস্যাগুলোকে, সেই সমস্যাগুলোর চরিত্র ও মূল কারণকে।... কোথায় রোগ, কোথায় সমস্যার মূল কারণ নিহিত এবং এই সমাজ যেটা পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, সেই পরিবর্তনের নিয়ম কি, তা ধরতে ও বুঝতে শেখায় মার্কসবাদ-লেনিনবাদ।
  • কমিউনিস্ট হওয়ার সাধনা একটি কঠিন সাধনা। এই বিপ্লবী রাজনীতি হচ্ছে একটা সর্বব্যাপক আন্দোলন যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলোকে 'ইন্টিগ্রেট' করে, অর্থাৎ সংযোজিত করে গড়ে ওঠে। এই ইন্টিগ্রেশনটি ঘটাতে পারলে তবেই সর্বহারা বিপ্লবী রাজনৈতিক আন্দোলন সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব।
  • আমি মনে করি, নিছক আত্মতৃপ্তির জন্য জ্ঞানচর্চা ও উদ্দেশ্যহীন শিক্ষালাভের কোন মানে নেই, একমাত্র প্রতিক্রিয়ার হাতকে শক্তিশালী করা ছাড়া। জনস্বার্থ ও প্রগতির অর্থে শিক্ষার একটি মাত্রই মানে জীবনে তার প্রয়োগ।
  • আমরা স্বাধীনতা দিবস একটা উৎসব হিসাবে উদযাপন না করে গণমুক্তি সংকল্প দিবস হিসাবে কেন উদযাপন করছি? তার কারণ, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটা অন্যতম লক্ষ্য জনসাধারণের সামনে ছিল স্বাধীনতা লাভ ও সর্বপ্রকার শোষণ থেকে মুক্তি অর্জন। সেই উদ্দেশ্য, সেই লক্ষ্য বর্তমান স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক কাঠামো জগদ্দল পাথরের মতো আমাদের বুকের উপর চেপে বসেছে তার দ্বারা পরিপূরিত তো হয়ইনি, উপরন্তু জনসাধারণের সে আশা-আকাঙক্ষাকে রূপায়িত করার পথে তা আজ একটা প্রচণ্ড বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই বাধা হটাতে না পারলে শোষণ থেকে জনসাধারণের মুক্তি অসম্ভব।
  • যে মানুষ এগোতে চাইবে, বাঁচতে চাইবে, তার শক্তির দরকার। এমন জ্ঞান অর্জন করা দরকার যে জ্ঞানের সাহায্যে সে সংগ্রামী হয়, নিজেকে পাল্টায়। আর নিজেকে পাল্টাতে পারলে সে দুনিয়াকেও পাল্টাতে পারবে।
  • আমি সেই মজুরের পক্ষে যে মজুরের সম্ভ্রম বোধ আছে, যে মজুরের ইজ্জত বোধ আছে, যে মরবে তবু ইজ্জত দেবে না। যে লড়াই করে আদায় করবে, সে সচেতন। যে দালাল মজুর, সে মজুর বলেই তার প্রতি আমার মমতা নাই।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা