অতুলচন্দ্র গুপ্ত

বাঙালি সাহিত্যিক

অতুলচন্দ্র গুপ্ত (১২ মার্চ ১৮৮৪ – ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১) বাঙালি সাহিত্যিক, বিশিষ্ট আইনজীবী এবং কাব্য-জিগযাসু ভাবুক ছিলেন। তিনি টাঙ্গাইল জেলার বিল্লাইক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন এবং কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ভারতীয় কংগ্রেস দলের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। গদ্যলেখক হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন।

উক্তি সম্পাদনা

  • প্রাচীন ভারতবর্ষের যে ইতিহাস নেই এই ঘটনায় আমরা কখনও লজ্জা পাই, কখনও গর্ব করি। আর সব সভ্যজাতির লোকেরা তাদের জয়-পরাজয় কাজ-আকাজের নানা কাহিনি লিখে গেছে, প্রাচীন হিন্দু তা করেনি। এই স্বাতন্ত্র্যকে, মনের অবস্থা—মতো, আধ্যাত্মিকতার প্রমাণও বলা চলে, আবার ঐতিহাসিক বোধের অভাবও বলা যায়। কিন্তু প্রাচীন ভারতবাসীর কথা যাই হোক, নবীন ভারতবাসীর ইতিহাসকে উপেক্ষা করার জো নেই। আধ্যাত্মিকতার দাবি তাদের পূর্বপুরুষদের ছেড়ে দিতে হয়েছে, সুতরাং আধুনিকতার দাবি আর ছাড়া চলে না, এবং ঐতিহাসিক বোধ হচ্ছে আধুনিকতার একটা প্রধান লক্ষণ। নবীন ভারতবাসীর প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস অনুসন্ধানের চেষ্টার মধ্যে প্রাচীনের উপর ঔৎসুক্য যতটা আছে, আধুনিকতার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ার লজ্জা তার চেয়ে কম নেই ।
  • প্রাচীন যুগের কথা শোনার মানুষের যে স্বাভাবিক আগ্রহ, আর ভবিষ্যৎ-মানুষকে নিজের কথা শোনাবার যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা, এই দুয়ে মিলে প্রকৃত ইতিহাসের সৃষ্টি। আজকের দিনের যেসব ছোটখাটো তুচ্ছ ঘটনা, অখ্যাত মানুষের অকিঞ্চিৎকর কাহিনি, মানুষের চোখ ও মন স্বভাবতই এড়িয়ে যায়, হাজার বছর আগেকার ঠিক এমনি সব ব্যাপারের কথা শুনতে মানুষের কৌতুহলের সীমা নেই। আবার হাজার বছর পরের মানুষের কাছে এইসব তুচ্ছ ঘটনা ও নগণ্য কাহিনিই কবির কথায়-সেদিন শুনাবে তাহা কবিত্বের সম।
  • অতীতের আলো-ছায়ার খেলায় মানুষের মনে যে বিস্ময়রসের সৃষ্টি করে ইতিহাসের তাই প্রধান আকর্ষণ। আর ছবি এঁকে, মুর্তি গড়ে, অক্ষরে লিখে অনাগত কালকে নিজের কথা জানাবার মানুষের যেসব উপায়, তারাই ইতিহাসের প্রধান উপকরণ। ভবিষ্যৎকে লক্ষ্য না করে শুধু বর্তমানে আবদ্ধ মানুষের যে ক্রিয়াকলাপ ও জীবনখাতা, তার প্রত্নখণ্ড দিয়ে ইতিহাসকে পরীক্ষা করা চলে, সৃষ্টি করা চলে না। মানুষ প্রাচীন ইতিহাস জানতে পারে, প্রাচীন কালের লোকেরা কোনও-না-কোনও উপায়ে সে ইতিহাস জানিয়ে গেছে বলে।
  • বর্তমান যদি অতীত কারণের কার্য হয়, অখণ্ড ঘটনা-প্রবাহের একটা অংশ মাত্র হয়, তবে ওই প্রবাহের বেগে তা নির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে ভেসে যাবেই। ইতিহাস সে দিকটা পূর্ব থেকে বলে দিতে পারে এ যদি সত্যও হয়, তবুও সে জ্ঞানের ফলে দিকের কোনও পরিবর্তন ঘটার কথা নয়। স্রোতের টানে কোথায় যাচ্ছি তা জানা থাকলেই সে গতিকে কিছু নিয়ন্ত্রিত করা যায় না। আর কমীরা যে দেশ-কাল-পাত্রের হিসাব করে কর্মে সফলতা লাভ করে তা বর্তমান দেশ, বর্তমান কাল ও বর্তমান পাত্র। সে বর্তমানের অতীত ইতিহাস অবশ্য আছে, কিন্তু কমীর যা সাবধানে হিসাব করতে হয় তা ওই ইতিহাস নয়, ইতিহাসের ফলে যে বর্তমান গড়ে উঠেছে সেই বর্তমান। যাকে পাথর কাটতে হয়, পাথরের গড়ন জানা তার দরকার। কিন্তু সে গড়নের যে ইতিহাস ভূতত্ত্ব থেকে জানা যায় তাতে তার প্রয়োজন হয় না। আর ভূতত্ত্বের পণ্ডিত যে পাথর কাটার কাজে অন্যের চেয়ে সহজে ওস্তাদি লাভ করতে পারে এ কথা অবশ্য কেউ বিশ্বাস করে না। পৃথিবীর বড় কর্মীরা সকলেই নিজের প্রতিভার আলোতে বর্তমানকে চিনে নিয়েছে, ইতিহাসের আলোতে নয়।
  • যাকে ‘ঐতিহাসিক সত্য' বলা হয়—যা থেকে মানুষ তার বর্তমান গতিবিধি সম্বন্ধে মূল্যবান উপদেশ পায় বলে অনেকের বিশ্বাস-তার স্বরূপটি কী? যা ঘটে গেছে সেই ঘটনার তথ্য নির্ণয় ‘ঐতিহাসিক সত্য' নয়, প্রত্নতত্ত্ব মাত্র। ইতিহাস থেকে যাঁরা উপদেশ চায়। তাঁরা ধরে নেয়, সে ঐতিহাসিক ঘটনার তথ্যের মধ্যে তত্ত্ব লুকিয়ে রয়েছে, যাকে ঘটনার বিশেষত্ব থেকে মুক্ত করে আবিশেষ সাধারণ সত্য বলে ব্যবহার করা চলে। ঐতিহাসিকের সবচেয়ে বড় কাজ, প্রত্নতত্ত্বের তথ্য থেকে এই ঐতিহাসিক সত্য বা তত্ত্বের আবিষ্কার করা। প্রতি ইতিহাসের মধ্যেই কোনও-না-কোনও তত্ত্ব আছে। যথার্থ ঐতিহাসিকের চোখে সে তত্ত্ব ধরা পড়ে ।
  • ইতিহাসকে যাঁরা উপদেশের খনি মনে করে তাঁরা তার এই রূপ-পরিবর্তনের কথাটা ভুলে থাকে। অথচ ইতিহাস সম্বন্ধে এর চেয়ে সহজ সত্য আর কী আছে। কোন বড় ঐতিহাসিক ঘটনা অথবা ব্যক্তির বিচারে ঐতিহাসিকেরা একমত? বেশি উদাহরণের প্রয়োজন নেই, এক ফরাসি বিপ্লব ও তার কমীদের যেসব ইতিহাস লেখা হয়েছে ও হচ্ছে, তার কথা মনে করলেই যথেষ্ট হবে। ইতিহাসের ঘটনা ঐতিহাসিক তত্ত্বের উদাহরণ নয়। ও তত্ত্ব মানুষ নিজের মনে মনে গড়ে নেয়, অর্থাৎ যার যেমন মন সে তেমনি তত্ত্ব ইতিহাসের মধ্যে খুঁজে পায়। ইতিহাসের যে উপদেশ তা ইতিহাস থেকে মানুষের মনে আসে না, মানুষ নিজের মন থেকে ইতিহাসে তা আরোপ করে।

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা