অরবিন্দ পোদ্দার

বাঙালি লেখক, সাহিত্য সমালোচক, প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক ও গবেষক

অরবিন্দ পোদ্দার (৩ নভেম্বর ১৯১৯ ―২০ জুন ২০২১) একজন বাঙালি লেখক, সাহিত্য সমালোচক, প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক ও গবেষক ছিলেন। মার্কসবাদী সমাজতত্ত্ব থেকে শুরু করে বাংলার নবজাগরণ, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাসে নিজের প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রেখেছেন। রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে ও কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তিনি সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্স স্টাডিজের ফেলো ছিলেন। বামপন্থী ভাবধারায় তিনি সাহিত্য সমালোচক ও প্রাবন্ধিক হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। তার গবেষণাগ্রন্থগুলি থেকে উপকৃত হয়েছেন বাংলার বিশিষ্ট বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিবর্গ ও অগণিত ছাত্রছাত্রী। লেখকের রচিত জনপ্রিয় গ্রন্থ, মানবধর্ম ও বাংলা কাব্যে মধ্যযুগ, বঙ্কিম মানস, শিল্প দৃষ্টি, রবীন্দ্রনাথের কিশোর সাহিত্য,রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ পরে, ইংরাজী সাহিত্য পরিচয়, রবীন্দ্রনাথ:রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ইত্যাদি।

উক্তি সম্পাদনা

  • মানবধর্ম ও বাংলা কাব্যে মধ্যযুগ' মুখ্যত সাহিত্যালোচনা, প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার কাবাভিব্যক্তির বিশ্লেষণ। যুগ যুগান্তরে পরিব্যাপ্ত ও রূপান্তরিত এই অভিব্যক্তির বিশ্লেষণে সহজেই একটা ক্রম বা বিবর্তনের সুর লক্ষণীয়। সেটা যেমন সামাজিক ক্রমের দিক থেকে, তেমনি কাব্য-শৈলী এবং ভাব-বস্তুর দিক থেকেও। এই ক্রমের স্বরূপ নির্ণয়, তার বৈশিষ্ট্যের আলোচনা ইত্যাদির মধ্যেই ‘মানবধর্ম’ নামকরণের সার্থকতা নিহিত রয়েছে বলে মনে হয়।
  • চর্যাগীতির রচনাকাল অর্থাৎ দশম থেকে দ্বাদশ শতক বাংলায় পালরাষ্ট্রের পতন, বর্মণ-সেন রাষ্ট্রের আবির্ভাব এবং সেনরাষ্ট্রের ক্রম তিরোভাবের কাল। সাধারণ- ভাবে এই যুগের মধ্যেই হিন্দু আধিপত্যের বিলুপ্তির চিহ্ন আঁকা রয়েছে। যুগ- সংক্রান্তির সময়টা স্বভাবতই চঞ্চল, নানা তরঙ্গবিক্ষুব্ধ । এই ধ্বংস-সৃষ্টি-ধ্বংসের আসা-যাওয়াটা চর্যাগীতির পটভূমি রূপে বর্তমান রয়েছে বলে চর্যাগীতির আলোচনা ও ভাবের অভিব্যক্তির অনুসন্ধানের পূর্বে এই যুগের পরিবেশ ও ভাব-মণ্ডল কি, তার বিচার করা প্রয়োজন।
  • খৃষ্টপূর্ব আমল থেকেই বাংলা দেশে উত্তর ভারতীয় আর্যসংস্কৃতির প্রভাব অল্পবিস্তর অনুভূত হতে থাকে; এবং গুপ্ত আধিপত্যের চরম বিকাশের দিনে তার সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবত, অনেকটা সচেতনভাবেই বাংলাকে উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ও সমাজবিন্যাসের অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা আরম্ভ হয়। বাংলায় বৈদিক শাস্ত্রাদির পঠনপাঠন, আলোচনা এবং অধিক সংখ্যক ব্রাহ্মণ সমাগম তারই সংকেত দেয়। খৃষ্টীয় তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম শতক থেকে আরম্ভ ক'রে চর্যাগীতির রচনাকাল পর্যন্ত— এই সুদীর্ঘ সময় বাংলার সামাজিক ইতিহাস ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির, সামাজিক আদর্শ ও ভাবধারার প্রসার, এবং পরিণামে রাষ্ট্রীয় সামাজিক ক্ষমতায় পূর্ণ গৌরবে অধিষ্ঠিত হওয়ার ইতিহাস। এই ইতিহাসের একদিকে রয়েছে বাংলার আর্যপূর্ব সংস্কৃতি ও সমাজ- বোধের সহিত আর্য সংস্কৃতি ও সমাজচিন্তার বিরোধ ও সংঘাত। এবং অপরদিকে পারস্পরিক গ্রহণ-সংমিশ্রণের জটিল কর্মপ্রবাহ পথে নবতর বোধ জীবনবিন্যাস ও জীবনাদর্শের আবির্ভাব।
  • সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মের ফাঁকে ফাঁকে বঙ্কিম-সাহিত্য সম্পর্কে অল্পবিস্তর অধ্যয়ন করিয়াছিলাম। সেই অধ্যয়নই ১৯৪৯ সালের প্রথম দু'তিন মাসে ‘বঙ্কিম-মানস' রূপে কাগজের পাতায় ফুটিয়া উঠে।
  • সাহিত্যজিজ্ঞাসায় যাহারা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন প্রয়োগ করেন, তাঁহাদের প্রয়োগটা অনেক সময়ই হয় যান্ত্রিক। তাঁহাদের অনেকেই বঙ্কিমচন্দ্রের দেহে প্রগতিশীল অথবা প্রতিক্রিয়াশীল লেবেল আঁটিয়া তাঁহাকে বিচার করেন, আসলে দ্বন্দ্বের, বিরোধের ভিতর দিয়া বিবর্তনের রূপটা তাঁহাদের কাছে ধরা পড়ে না । আমি বঙ্কিমচন্দ্রকে সমকালীন ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজ, সংস্কৃতি ও সম্পর্কের মধ্যে স্থাপন করিয়া, কি ভাবে ইউরোপীয় যুক্তিবাদ ও সনাতন হিন্দু চিন্তাধারার বিরোধের মধ্য দিয়া তাঁহার মন ও শিল্প বিবর্তিত হইয়াছে, তাহা দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছি। আমার এ প্রচেষ্টা কতদূর সার্থক হইয়াছে তাহার বিচার করিবেন।
  • কোন কালই আপনাতে আপনি সমৃদ্ধ অথবা স্বয়ম্ভূ নয়। সমাজ মানুষের স্বাভাবিক গতি ও বৈচিত্রের ন্যায় তাহারও জন্ম আছে, বিকাশ আছে, আবার তেমনি মৃত্যু আছে। সুতরাং কোন কালকে জানিতে হইলে প্রয়োজন তাহার জাতপত্রের ; এই যুগের সার্থক পরিচয়ের জন্য কোন্ পরিবেশে, কোন্ কোন্ সামাজিক শক্তির ক্রিয়ায় এবং ঘাতপ্রতিঘাতের তরঙ্গে ইহার আবির্ভাব, তাহা জানা অপরিহার্য । ইতিহাস অবিশ্রান্ত ধারায় প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে ; ঐতিহাসিক বিবর্তনের কোন স্তরেই স্থির, নিস্পন্দ দাড়াইয়া থাকা সম্ভব নয় । তাই, বিকাশের সহজ নিয়মেই কাল কালান্তরে পরিণত হয় ৷ এই কালান্তরে প্রবেশের মুখে ইতিহাস কোন্ কোন্ শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হইতেছে, ইহার গতিপথের স্বরূপ কি, তাহা নিরূপণ করিতে পারিলে নুতন কালের বিকাশ ধারা এবং ইহার যুগ-বৈশিষ্ট অনুধাবন ও উপলব্ধি করা যায়। আবার কালপ্রবাহের অমোঘ অনুশাসনে যখন এই কালেরও অন্তর্ধানের সময় আসিবে, তখন তিরোধানের লগ্নে সে কোন্ নূতন কালকে সৃষ্টি করিয়া যাইবে, কালের বর্তমান স্বরূপের মধ্যে তাহার সাক্ষাৎ পাওয়াও সম্ভব।
  • বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বগামী কালে এক গভীর সামাজিক-বিক্ষোভ পরিলক্ষিত হয় । ভারতে বৃটিশ বিজয়ে এই বিক্ষোভের সূত্রপাত, এবং সনাতন ভাবধারা ও নুন চিন্তাধারার সংঘাতের মধ্যে এই বিক্ষোভের বিকাশ। এই বিক্ষোভের মধ্য দিয়া, অলক্ষ্যে, রূপান্তরের কাজ চলিয়াছিল ; ভারতে নূতন ব্যক্তি-সত্তা ও সংস্কৃতির আবির্ভাব হইতেছিল। পরবর্তীকালে এই ব্যক্তি-সত্তাই প্রয়োজন ও সুবিধা মত নিজেকে সৃষ্টি করিয়াছে। সুতরাং এই সংস্কৃতি ও রূপান্তরধর্মী ব্যক্তি-সত্তার স্বরূপের মধ্যে বঙ্কিম-যুগের বৈশিষ্ট নিহিত রহিয়াছে ।
  • ভারতে বৃটিশ বিজয়ের ফলে ভারতীয় সমাজ কাঠামোয় মৌলিক রূপান্তর সাধিত হয়। এই সমাজ-সঙ্কটের মধ্যে প্রাচীন ভারতীয় সমাজের তিরোধান এবং নূতন এক যুগের আবির্ভাব হইতেছিল। প্রাচীন সমাজের অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে সেই সমাজের কর্ষক, ধারক এবং বিধায়ক বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী ও চিন্তা- মানসেরও তিরোভাব হয়। আর সেই তিরোভাবের অন্তরালে নুতন সামাজিক শ্রেণী আত্মপ্রকাশ করে, যাহারা ভারতে নব সংস্কৃতির পত্তন করে।
  • প্রথম পর্যায়ের বৃটিশ শাসনের বৈশিষ্ট আলোচনা করিলে সহজেই একটা দ্বৈতরূপ ধরা পড়ে; তাহা একদিকে না-ধর্মী এবং অপর দিকে হাঁ-ধর্মী । ব্যবহারিক রাজনীতি বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করিলে দেখা যায়, ইহা ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজ-কাঠামোকে ধ্বংস করিয়াছে, সেই কাঠামো উপযোগী দৃষ্টিকোণকে এবং গ্রামীণ বিচ্ছন্নতাকে বিনষ্ট করিয়াছে, আঘাত করিয়াছে সেই সমাজের চিন্তাধারাকে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই সমাজে যা ছিল কল্যাণধর্মী, যা ছিল শ্রেয়, তাহাকেও নির্মমভাবে বিনষ্ট করিয়াছে। কিন্তু, অপর পক্ষে, নূতনকে সে সৃষ্টিও করিয়াছে; ভারতে ধনতান্ত্রিক বিকাশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করিয়াছে; বিচ্ছিন্নতা দূর করিয়া রাজনৈতিক দিক হইতে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করিয়াছে ; পৃথিবীর অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক ও অর্থ- নৈতিক জীবনের সহিত ভারতের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র স্থাপন করিয়াছে, আর, যতই অনিচ্ছাসত্ত্বে হউক না কেন, ভারতে নব... ভাবধারায় পুষ্ট, রাষ্ট্র পরি চালনায় সমর্থ নূতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সৃষ্টি করিয়াছে। বলা বাহুল্য, বৃটিশ বণিকতন্ত্রের বাণিজ্যিক স্বার্থানুকুল্যেই এই সব রূপান্তর সাধিত হয়।
  • তৎকালীন নমাজের পারমার্থি‌ক কল্যাণের বিধায়ক যাহারা ছিলেন, তাহাদের মধ্যেও দুর্নীতির প্রসার ছিল ব্যাপক।
  • সে কালে ভারতপ্রবাসী ইংরেজদের মধ্যে দুর্নীতি ছিল ব্যাপক ও অবিমিশ্র। অনুকরণ প্রয়াসী নূতন ভারতীয় শ্রেণী এই জাতীয় হীনচরিত্র ইংরেজকেই আদর্শ হিসাবে সম্মুখে রাখিয়াছে। সুতরাং “তখন মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, উৎকোচ, জাল, জুয়াচুরী প্রভৃতির দ্বারা অর্থ সঞ্চয় করিয়া ধনী হওয়া কিছুই লজ্জার বিষয় ছিলনা। বরং কোন ও সুহৃদগোষ্ঠীতে পাঁচজন লোক একত্র বসিলে এরূপ ব্যক্তিদের কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা হইত ।
  • ইংরেজের সর্ববিধ কার্যকে নিঃসঙ্কোচে সমর্থন করা ছাড়া আর কোন কার্যক্রম শিক্ষিত সমাজের পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা, তাহা আজ নির্ণয় করা কঠিন ৷ বৃটিশ বণিকতন্ত্রের আঘাতে ভারতের শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংস হওয়ায় এবং ভারতবর্ষ মূলতঃ কাচামাল সরবরাহকারী উপনিবেশে পরিণত হওয়ায়, নূতন ভূস্বামী পরিবার- সমূহের শিক্ষিত যুবকদের পক্ষে ( ভূস্বামী পরিবারের সন্তানরাই সর্বপ্রথম ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করে) শিল্প-বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ ছিল না; অতএব কোম্পানীর অধীনে দায়িত্বসম্পন্ন চাকুরী গ্রহণই তাহাদের পক্ষে একমাত্র লোভনীয় বৃত্তি ছিল।


বহিঃসংযোগ সম্পাদনা