আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
(আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ থেকে পুনর্নির্দেশিত)

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ (জন্ম ২৫ জুলাই ১৯৩৯) বাংলাদেশের একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক। তার জীবনের উল্লেখযোগ্য কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, যা চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশে ‘আলোকিত মানুষ’ তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ২০০৪ সালে তিনি রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

বাংলাদেশে অ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০০৫ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। প্রবন্ধে অবদানের জন্য তিনি ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭০-এর দশকে তিনি টিভি উপস্থাপক হিসাবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

  • মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।
  • আসলে জীবন ছোট নয় আমাদের সুখের মুহূর্তগুলো ছোট। তাছাড়া জীবন ছোট মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে স্মৃতির অভাব। আমরা কখনো বর্তমানে থাকিনা। হয় থাকি ভবিষ্যতে, না হয় অতীতে। আমরা পাওয়াকে ভুলে যাই বলেই মনে হয় কিছুই পাই নাই।
  • অপ্রয়োজনের জিনিস সুন্দর হয়, প্রয়োজনের জিনিস গাড়লের মতো হয়।
  • সেটুকুই আমরা, যেটুকু আমরা সংগ্রাম করি।
  • যে কোনো জাতির প্রতিভাবানেরা সে জাতির গড়পড়তা মানুষের সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা সবাই সে জাতির প্রিয় প্রতিপক্ষ।
  • প্রেম শব্দটির মানে হচ্ছে না পাওয়া।
  • কেউ বলেনি তুমি পারবে না, তুমিই বলছ।
  • মেধাবীরা বিদেশে গেলেই জাতি মেধাশূন্য হয় না। যে ২০ ভাগ থাকে, তারা এগিয়ে আসে। কিছু সময় বিশৃঙ্খলা থাকে, কিন্তু ওই কুড়ি ভাগ মেধাবীরা শূন্যতা পূরণ করে ফেলে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বেশ শোচনীয় পর্যায়ে গেছে। তারপরও হতাশ হব না। অগ্রসর মানুষ থাকে কতিপয়, বাকিরা তাদের অনুসরণ করে। তারাই উচ্চতর জাতি তৈরি করে। আজকে সবকিছু ভেঙে পড়ছে। কারণ, একটা উচ্চতর জাতি তৈরি করতে যোগ্য মানুষ লাগে। তাদের সংখ্যা এখন শোচনীয়ভাবে কমে গেছে। এটা এ জন্য নয় যে এদের আশি ভাগ বিদেশে চলে গেছে। মেধাবীরা বিদেশে গেলেই জাতি মেধাশূন্য হয় না। যে ২০ ভাগ থাকে, তারা এগিয়ে আসে। কিছু সময় বিশৃঙ্খলা থাকে, কিন্তু ওই কুড়ি ভাগ মেধাবীরা শূন্যতা পূরণ করে ফেলে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বেশ শোচনীয় পর্যায়ে গেছে। তারপরও হতাশ হব না। আমরা দেড় কোটি শিক্ষার্থীর কাছে পাঠ্যবইয়ের বাইরের সেরা বইগুলো নিয়ে গেছি। এখন এই সংখ্যা দুই কোটি হতে যাচ্ছে। এক ভাগও যদি এর মধ্যে সত্যিকারের আলোকিত হয়, তাহলে দুই লাখ। এরা নেতৃত্ব দেবে। দেশ আলোকিত হবে। সেই যে একুশের শহীদদের আত্মত্যাগ, এই যে একাত্তরে আমাদের আত্মত্যাগ, আত্মদান, তাদের সংগ্রাম বৃথা যাবে না। তবে আমাদের কর্তব্য করে যেতে হবে। মানুষ উষ্ণ রক্তের প্রাণী। আমাদের শীতকালে গর্তে ঢুকে শীতনিদ্রায় যেতে হবে, তা হয় না। আমরা চেষ্টা করব, উদ্যোগ নেব এবং বাংলাদেশকে সফল করব। আমাদের দেশ হবে একুশের আলোয় আলোকিত দেশ, বিজয়ের আলোয় বিজয়ী দেশ।
    • প্রথম আলো, প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: লেখক ও প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
  • আমি মনে করি, জীবনকে আমরা যা আদেশ দিতে পারি, জীবন তা-ই নতমস্তকে মেনে নেয়। একটা কবিতা বলে আজকের কথা শেষ করি। একটা চীনা কবিতা। কবিতাটা অনুবাদ করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। খুবই সুন্দর অনুবাদ। কবিতাটা কবি লিখেছিলেন বার্ধক্যের নিঃস্বতা বোঝানোর জন্য। কিন্তু সেদিন পড়ে মনে হলো কবিতাটা পুরো বার্ধক্যবিরোধী একটা কবিতা। কবিতাটা এ রকম:
    ‘হাওয়া বয় শনশন
    তারারা কাঁপে।
    হৃদয়ে কি জং ধরে
    পুরোনো খাপে।’
    জীবন যখন বসন্ত-রঙিন হয়ে উঠেছে, আমার হৃদয়ে তখন জং-ধরা বিমর্ষতা। জং ধরেছে কোথায়?
    ‘পুরোনো খাপে’—মানে এই বৃদ্ধ শরীরে।
    ‘কার চুল এলোমেলো,
    কিবা তাতে এল গেল
    কার চোখে কত জল
    কী হবে মেপে।’
    এবার আমার কথাটা বলি। মানছি জীবনে বার্ধক্য এসেছে। কিন্তু তাই বলে কি মেনে নিতে হবে আমার হৃদয়ও বৃদ্ধ? শুধু বুড়ো হয়েছি বলে ‘কার চুল এলোমেলো’, তাতে কি কিছুই যায়–আসে না? (তরুণদের উদ্দেশে) বলো তরুণেরা, এতে কি কিছু যায়–আসে?

    ‘কার চোখে কত জল কী হবে মেপে’ বুড়ো হয়েছি বলে কি কার চোখে কত জল, সেটুকু মাপাও বন্ধ করে দিতে হবে? হৃদয়ের পাতা ঝরতে শুরু করেছে বলে কি সব শেষ?
    জং-ধরা জীবনের নিঃস্বতা নিয়ে কবির সর্বশেষ কথা:
    ‘জেনে কিবা প্রয়োজন
    অনেক দূরের বন
    রাঙা হলো কুসুমে
    না বহ্নিতাপে।’
    • প্রথম আলো, প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৩, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: লেখক ও প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পর্কে উক্তি

সম্পাদনা
  • ২০২৪ সালেও আমি আশার কথা ভাবি। যদি ভাবতেই হয়, নৈরাশ্যের কথা ভেবে তো কোনো লাভ হবে না। মানব জাতি চিরকাল উন্নত মহত্তর এক জীবনের স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু সেই স্বপ্ন কখনোই পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। হয়নি বলেই মানুষ আবার নতুন করে স্বপ্ন রচনা করে, নতুন করে সামনে অগ্রসর হয়। আজকে আমরা আপন ঘরে বসে যেসব হতাশার কথা ভেবে ব্যথিত হচ্ছি, হয়তো ১৮৯০ সালে লন্ডনের কোনো এক ঘরের কোনায় আমাদের মতো কোনো মধ্যবিত্ত একই কথা বলেছে। আমরা কখনো একটা সমৃদ্ধ জীবনকে একবারে পাইনি। কিন্তু আমরা সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন দেখেছি। এটা দুটো কাজ করেছে। ১. এটা আমাদের পতনের দিকে অত সহজেই যেতে দেয়নি। হয়তো পতন ঘটে গেছে, কিন্তু পতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। ২. আমাদের মধ্যে নিঃশব্দ উন্নতি ঘটেছে।
    • প্রথম আলো, প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৪ , আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: লেখক ও প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
  • মানুষ কী করে এসব নিয়ে বেঁচে থাকে পৃথিবীতে—এত বৈরিতা উতরে—খুবই আশ্চর্য ব্যাপার! প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর সম্ভাবনা, সবখানে বিপদের ফাঁদ। এত সব পার হয়ে আজ আমি ৮০ বছরে পা রেখেছি। একেই আমি জীবনের একটা সাফল্য মনে করি। হয়তো ৮০ বছর পার করেই এ কথা বলা উচিত, কিন্তু যদি সে সুযোগ না পাই; তাই আজকেই বলে রাখলাম।
    • প্রথম আলো, প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৩, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: লেখক ও প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
  • ছোটবেলায় কলকাতায় গেছি নানার বাড়িতে বেড়াতে, আমার বয়স তখন বছর ছয়েক। দিনকয়েক পর হঠাৎ দেখলাম, নানা আমাদের ওপর ভয়ংকর ক্রুদ্ধ। থেকে থেকে গর্জন করছেন, ‘এগুলোকে তাড়া এ বাড়ি থেকে—আজই। ওই জংলিদের এখানে রাখা যাবে না।’ নানার চেহারা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। তাঁর কথাগুলো আমার বুকের ভেতর গিয়ে লাগল। এইভাবে অপমান! আমি এর প্রতিশোধ নেওয়ার পথ খুঁজতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত একটা উপায় বেরোল। আমি একটা কাগজে লিখলাম, ‘আর কোনো দিন এই বাড়িতে আসিব না।’ লিখলাম, কিন্তু আতঙ্কে আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে এল। নানার হাতে আমার কাগজটা যদি পড়ে যায়! এ আতঙ্কের কারণ আছে। নানা কলকাতায় থাকেন। কলকাতা মানে চিড়িয়াখানা, কলকাতা মানে আইসক্রিম, কলকাতা মানে নানা রঙের গাড়ি, সারি সারি দালান—আমাদের শৈশবের স্বর্গরাজ্য। আর আমরা থাকি প্রায় গ্রামে। কাগজটা নানার হাতে পড়ার মানে একটাই—এমন কলকাতা থেকে চিরকালের জন্য নির্বাসন, এককথায় স্বর্গ থেকে বিতাড়ন হওয়া। আতঙ্কে আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে এল। শেষ পর্যন্ত একটা বুদ্ধি বের করলাম। কয়লার চুলা ধরানোর জন্য নানার বাড়ির একতলায় ছিল একটা চেরা কাঠের উঁচু ঢিবি। খুবই সন্তর্পণে তার একেবারে নিচে চিঠিটা ঢুকিয়ে দিলাম; যাতে অন্যায়ের প্রতিবাদও জানানো হলো অথচ নানাও কোনো দিন তার খোঁজ পাবেন না।
    • প্রথম আলো, প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৩, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: লেখক ও প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
  • ৪০ বছর আর ৮০ বছর—এ দুটো বছর জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ৪০ বছর হলো জীবনের পরিণতির সূচনা। আর ৮০ বছর হচ্ছে জীবনের পরিণতির শেষ। ৮০ বছর মানে এরপর আর নতুন কিছুই হবে না। খালি পুনরাবৃত্তি, কোনো নতুনত্ব নেই। আপনারা সবাই রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটা জানেন:
    • প্রথম আলো, প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৩, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: লেখক ও প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
  • আমরা যে অসম্ভবে বিশ্বাস করতে পারি, একদিন আমরা তা হয়ে যাই। আমি নিৎশের লেখা পড়তে গিয়ে সেদিন দেখলাম, তিনি লিখেছেন, নৈরাশ্যবাদ দেখা দিলে বুঝতে হবে একটা ক্ষয় সেখানে কাজ করছে। সে তুলনায় আশাবাদ অনেক ওপরতলসর্বস্ব। কিন্তু ওপরতলের হলেও আমি আশাবাদীই হতে চাই। কেননা, আশাবাদ শক্তি জোগায়। আমার সঙ্গে এক বছরের একটা শিশুর কী পার্থক্য? আমিও বেঁচে আছি, সে–ও বেঁচে আছে। আমি তাই নিজেকে যেকোনো বয়সের সমবয়সী ভাবতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করি না। আবার জীবনকে ৮০ বছর না ভেবে তো পারছিও না। এ–ও তো জীবনের আরেক দিক। এর হাত থেকেও রেহাই কোথায়?
    • প্রথম আলো, প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৩, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: লেখক ও প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
  • সবই যাবে কিন্তু জীবনকে যে যতটা ধরে রাখতে পারবে, জীবনকে সে ততটাই বেশি পাবে। সফল হই বিফল হই, চেষ্টা অন্তত এ ব্যাপারে থাকুক। ইকবালের একটা কবিতা থেকে তিনটি বেগবান লাইন বলে শেষ করছি:
    ‘দুর্বার তরঙ্গ এক বলে গেল তীর তীব্র বেগে
    আমি আছি যতক্ষণ গতিমান আমি
    যখনি হারাই গতি সে মুহূর্তে আমি আর নাই।’
    দেখুন, এ জন্যই পৃথিবীতে বৃদ্ধ দরকার। কিন্তু না, আপনারটাও ভাই সঠিক হয়নি। মুখে আমরা যুবক-যুবক করলেও বৃদ্ধ যে হয়েছি, তাতেও তো ভুল নেই। আমরা একজন ভুলে গেছি, একজন ভুল করেছি। মাথা থেকে বহু কিছুই ঝরে যাচ্ছে। ছেলেবেলায় শুনতাম, ৯০ বছর হলে নাকি স্বামী-স্ত্রীকে নতুন করে বিয়ে দিতে হয়; কারণ তত দিনে তারা নাকি আগের সবকিছু ভুলে যায়। সুতরাং নতুন করে বিয়ে হলে আবার নতুন করে পরিচয়, নতুন চেনাজানা, নতুন করে ‘ওগো, হ্যাঁগো’—এসব শুরু হয়।
    আমাদেরও হয়তো সবকিছু তেমনি নতুন করে শুরু হবে।
    ৮০ বছরে পড়েছি বলে কি ওই দুর্বার গতিও শেষ হয়েছে? আমি তো মনে করি, অন্য এক গতির জন্য এইবার সর্বশেষ যুদ্ধ। যৌবনে প্রকৃতি আমাকে যোদ্ধা বানিয়েছিল। এখন প্রকৃতি নেই, এবার আমিই নিজেই যোদ্ধা।
    • প্রথম আলো, প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৩, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: লেখক ও প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা