আমজাদ আলী খন্দকার

আমজাদ আলী খন্দকার ছিলেন বিটিভির ক্যামেরাম্যান। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের মত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্র ধারণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় তিনি ২০২২ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।

  • আমি ছিলাম বঙ্গবন্ধুর সামনে কাজের সূত্রে তার ভাষণ রেকর্ড করার জন্য। ভাষণ যথারীতি শুরু হলো। বঙ্গবন্ধু ডান হাতের তর্জনি উঁচিয়ে সেই বক্তব্য শুনছিলাম। আর অবাক হয়ে দেখছিলাম। সামনে নেই কোনো কাগজ । যেন মুখস্থ বলে যাচ্ছেন একের পর এক। কতক্ষণ রেকর্ড করেছি তা মনে নেই। কিন্তু মনে হচ্ছিল আমি যেন এক মহামানবের কথা শুনছি। একবার চোখ মেলে তাকালাম চারদিকে। শুধু মানুষ আর মানুষ। মাথা আর মাথা।
  • তখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ফিল্ম ডেভেলপ করে নিয়ে আসব, সে ব্যবস্থা আমাদের ছিল না। সেটা করতে যেতে হত এফডিসি ল্যাবে। বঙ্গবন্ধুর নাম দেখলে এটা নষ্ট করে ফেলবে, সেজন্য আমরা কৌশল করে ‘সাইক্লোন’ চিহ্ন দিয়ে এফডিসি থেকে ডেভেলপ করে নিয়ে আসলাম, যাতে অন্যরা মনে করে, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় সংশ্লিষ্ট ফিল্ম এগুলো।
  • আমার উপর দায়িত্ব পড়ল বঙ্গবন্ধুর ভাষণের টেপ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের পাহারা ও নজর পেরিয়ে সচিবালয় পার করা। সেখান থেকে সোজা সচিবালয়ে কার্যালয়েই ফিরলাম। সেদিনের আগের দিনে বাবার সাথে দেখা করলেও বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান থাকলেও তাদের সঙ্গে দেখা করিনি। কারণ, তাদের সঙ্গে দেখা করলে কান্নাকাটি শুরু করবে তারা। সন্তানের মায়া লেগে যেতে পারে বলেই যাইনি বাসায়।
  • কার্যালয়ে আসার পর আমাকে ট্রাঙ্ক নিয়ে পালানোর পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেন স্যার। এর পর খায়ের সাহেব আমাকে রুমের ভেতর নিয়ে গেল। আমাকে রুমের ভেতর নিয়ে বিদায় দিলেন। আমার হাত ধরে বললেন, আমজাদ আল্লাহ হাফেজ। ওনার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। কারণ উনি জানতেন যদি ধরা পড়ি তাহলে আর বাঁচবো না।
  • আমরা যতজন বেঁচে আছি, ৭ই মার্চের এই ঘটনা নিয়েই বেঁচে আছি। কিন্তু জাতির কাছ থেকে আমরা তো কিছু পেলাম না। সরকার কতজনকে কত কিছু করে দিল। অনেকে প্লট পেল, বাড়ি পেল। আমাদের কেউ খোঁজও নিল না।
  • একদিন দেখি, ছোট একটা ঘরে বাবার কোলে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। আমি ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারিনি। ঘুম ভেঙে গেছে শব্দে। উনি কপট রাগ দেখিয়ে বলেন—ওকে আটক করো। আমি বিয়া খামু ছবি তুলবে, বাপের কোলে শুবো তারও ছবি তুলবো?
  • একের পর এক রিল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের ফিল্ম বিভাগে আমার চেনা অনেকেরই চাকরি চলে গেলো। আমাকেও বিদায় নিতে হলো । কত কারসাজি করলো। সব পাকিস্তানি মানসিকতার প্রেতাত্মারা চলে এলো। আমাকে নানাভাবে বঞ্চিত করে বিদায় করলো। পরে ৭৯ সালে আবারও বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটা পোস্টে আমাকে নতুন করে নেওয়া হলো। তখন ভাষণের ফিল্ম ডিএফপিতে ছিল। সেখানেও তো আমাদের কিছু লোক ছিল। তারা রিলের বক্স চেঞ্জ করে বাঁচিয়েছিল। আর প্রেতাত্মারা আগের রিলবক্স পুড়িয়ে ভেবেছিল কাজ সেরে ফেলেছে, কিন্তু তারা কখনোই তা করতে পারে নি।
  • আমরা রেকর্ডিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকায় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের প্রতি তেমন মনোযোগ দিতে পারিনি তবে বঙ্গবন্ধু যেভাবে তার ভাষণে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন তাতে আমরা ভীষণভাবে আলোড়িত হয়েছিলাম।

আমজাদ আলী খন্দকার সম্পর্কে উক্তি

সম্পাদনা
  • বাঙালির সেই মুক্তি সনদ, যা ৭ মার্চের ভাষণ হিসেবে পরিচিত। সেই ভাষণের মূলকপি বা রেকর্ডটি পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করতে দীর্ঘদিন দোহার চরকুশাই খানবাড়ির ধানের গোলার ভেতর লুকিয়ে রাখা হয়। পরে সেটি ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। এতপর ভারত থেকে বেশকিছু কপি করে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। সেই কপিগুলোও পাকবাহিনী নষ্ট করতে চেষ্টা করে। তৎকালীন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের ক্যামেরা সহকারী হিসেবে কাজ করতেন খন্দকার আমজাদ আলী। তিনিই এ রেকর্ড সংরক্ষণে সহযোগিতা করেছিলেন।
  • পুরো ঢাকা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বঙ্গবন্ধুর রেকর্ড করা ভাষণের টেপ সচিবালয় থেকে বের করতে হবে - কাজটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সচিবালয়ও তখন সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বাঙালি অফিসার-কর্মচারীদের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সচিবালয় থেকে ভাষণের ক্যান ও অন্যান্য জিনিস বের করা কঠিন কাজ। সামরিক বাহিনীর লোকজন বুঝতে পারলে মৃত্যু অনিবার্য। এরপর সচিবালয় থেকে সোয়ারীঘাট। পথে পথে সামরিক বাহিনীর টহল। এত বিপৎসংকুল বাধা পেরোতে হবে জেনেও আমজাদ আলী খন্দকার রাজি হন এবং সফলও হন।
  • এই স্বীকৃতিটুকু খন্দকার আলী আমজাদকে সুখী করেছে নিশ্চিত কিন্তু অকস্মাৎ পদকপ্রাপ্তিতে খুশি হয়ে ওঠা এই বৃদ্ধের জীবনের ভার লাঘবে এই পদক কি কোনো ভূমিকা রাখবে? কিংবা সারা জীবন ঢাকায় সরকারি বাসায় থাকার পরও যে মানুষটিকে অনিচ্ছায়, অনেকটা নিরুপায় হয়ে ঢাকা শহরের জীবন ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে একেবারে নিভৃতে, লোকচক্ষুর অন্তরালে তাঁর জীবনে কি কোনো পরিবর্তন আনবে এই পদক? এই পদক প্রাপ্তিতে পাশের বাসার মানুষটির মধ্যেও কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, এক তোড়া ফুল বা এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়েও কেউ আসে না অভিনন্দিত করতে! কেউ জানে না, কেন তিনি পেলেন একুশে পদক।
  • পাকিস্তান সরকার যাতে ভাষণটি বিনষ্ট না করতে পারে, সেক্ষেত্রে ক্যামেরা সহকারী আমজাদ আলী খন্দকারের ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। তিনি জীবন বাজি রেখে পাকসেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সচিবালয় থেকে ঢাকার দোহারে নিয়ে যেয়ে ধানের গোলায় লুকিয়ে রাখেন। সেখানে মাস খানেক রাখার পর প্রতিকূল অবস্থা বিবেচনাপূর্বক সমমনা সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা নিয়ে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আর ডিসেম্বরে (১৯৭১) বিজয় অর্জন করার পর ভিডিও টেপটি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা