আলেয়া (নাটক)
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত নাটক
এটি সম্পর্কিত একটি অসম্পূর্ণ পাতা। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে সহায়তা করতে পারেন। |
আলেয়া কাজী নজরুল ইসলাম রচিত দ্বিতীয় নাটক। এটি ১৯৩১ সালে মঞ্চস্থ ও প্রকাশিত হয়। মরুতৃষা শিরোনামে লিখলেও পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে আলেয়া করা হয়। ত্রিভুজ প্রেম ও তার পরিণয় এই নাটকের প্রধান বিষয়বস্তু। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র জয়ন্তীর প্রেমের ব্যাকুলতা, সিদ্ধান্তহীনতা এবং আবেগের তীব্রতা নাটকটিকে ট্র্যাজিক পরিণয়ের দিকে নিয়ে গেছে। নাটকটি প্রথম মঞ্চায়নের সময় জনপ্রিয় ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মায়ার খেলা নাটকের সাথে এর বিষয়বস্তুর মিল থাকলেও নজরুল গল্পের জটিলতা ও নাট্যের তীব্র গতি দিয়ে একে স্বতন্ত্র করে তুলেছেন।
উক্তি
সম্পাদনা- যে-তেজে যে-শক্তিতে নারী রাণী হয়, নারীর সেই তেজ সেই শক্তি।
- জয়ন্তী এর বর্ণনা।
- নারীর হৃদয়—তাদের ভালোবাসা কুহেলিকাময়। এও এক আলেয়া। এ যে কখন্ কা'কে চায়, তা চির-রহস্যের তিমিরে আচ্ছন্ন।
- ভূমিকা
- পুরুষও তেমনি হৃদয় হ'তে হৃদয়ান্তরে তার মানসীকে খুঁজে ফেরে। তাই তার কাছে আজকার সুন্দর, কাল হ'য়ে ওঠে বাসি। হৃদয়ের এই তীর্থ-পথে তার যাত্রার আর শেষ নেই। তাই সে এক মন্দিরে পূজা নিবেদন ক'রে আর মন্দিরের বেদীতলে গিয়ে লুটিয়ে গড়ে।
- ভূমিকা
- হৃদয়ের এই রহস্যই মানুষকে করেছে চির-রহস্যময়, পৃথিবীকে করেছে বিচিত্র-সুন্দর।
- ভূমিকা
- নিশি নিশি মোরে ডাকে সে স্বপনে ।
নিরাশার আলো জ্বালিয়া গোপনে ॥
জানিনা মায়াবিনী কি মায়া জানে,
কেবলি বাহিরে পরাণ টানে
ঘু'রে ঘু'রে মরি আঁধার গহনে ॥
শত পথিকে ও রূপে ছল হানে,
অপরূপা শত রূপে শত গানে।
পথে পথে বাজে তাহারই বাঁশী,
সে সুরে নিখিল-মন উদাসী,
দহে যাদুকরী বিধুর দহনে ।।- পথিক, প্রস্তাবনা
- চলিতে ফুলদলি, চাহে যে তারে ছলি
সেই সে পথে চলি, যে পথে আলেয়া-ছল ।- প্রজাপতিদ্বয়, পৃ.৪
- মোরা অনির্ববাণ-শিখা দীপ্তিমতী,
আমরা কুসুম রাঙা আমরা জ্যোতি ।- কিশোরীরা, পৃ.৫
- পোহাল পোহাল নিশি খোল গো আঁখি ।
কুঞ্জ-দুয়ারে তব ডাকিছে পাখী ।।
এ বংশী বাজে দূরে শোনো ঘুম-ভাঙানো সুরে,
খুলি' দ্বার বঁধু রে লহগো ডাকি।- ভোরের হাওয়া, পৃ.৭
- ফুল কিশোরী! জাগো জাগো, নিশি ভোর ।
দুয়ারে দখিণ হাওয়া—খোল খোল পল্পব-দোর ॥
জাগাইয়া ধীরে ধীরে যৌবন তনু-তীরে
চ'লে যাবে উদাসী কিশোর ।।- কাকলি, পৃ.৮
- পশ্চাতে ওই উদ্দাম জলপ্রপাত, আর সম্মুখে এই রূপ-যৌবনের উচ্ছল বর্ণাধারা; মধ্যে দাড়িয়ে আমি, তৃষ্ণার্ত্ত ভোগলিপ্সু পুরুষ, যৌবনের দেবতা!
- মীনকেতু, পৃ.৯
- "আমরা জানি মাতাল হইয়ে পাতাল পানে ধাওয়া"
- কবি, পৃ.১০
- গাও, গাও, মন টেঁকার গান গাও! যে-গান শুনে সকালবেলার ফুল বিকালবেলার কথা ভুলে যায়, ভোরের নিশি সূর্য্যোদয়ের কথা ভোলে ; বনের পাখী নীড়ের পথ ভোলে—সেই গান ।
- মীনকেতু, পৃ.১০-১১
- তটে তটে ঘট-কঙ্কনে নট-মল্লারে ওঠে গান,
মুখে হাসি বুকে শ্মশান ।
আজিও তরুণী ধরা রঙে রূপে ঝলমল,
রূপে রসে চলঢল্ ॥- সুন্দরীরা, পৃ.১১
- আমি কৃষ্ণা, নিশিথিনী। আমি নীরবে আসি, নীরবে যাই। হয়ত-বা আমার চোখের শিশিরেই তোমাদের কাননের ফুল ফোটে !
- কৃষ্ণা, পৃ.১২
- কিন্তু সম্রাট্, আপনার যা খেলা, তা হয়ত অন্যের মৃত্যু!
- কৃষ্ণা, পৃ.১৩
- দাওয়াতে টানছে হুঁকো, উনুন-মুখো,
নড়েও নাকো ন্যাজমলাতে ।
ভাই সব বল হরি, কল্সী দড়ি, ঝুলিয়েছে
নিজেই গলাতে ॥- কবি, পৃ.১৪
- সম্রাট্, একজনের মুখ যখন আর-একজনের কর্ণমূলের দিকে এগিয়ে আসে, তখন লজ্জার দায় এড়াতে তৃতীয় ব্যক্তির সেখান থেকে সরে' পড়াই শোভন এবং রীতি । [প্রস্থান]
- কবি, পৃ.১৫
- তুমি আমায় জান কৃষ্ণা, আমি সিংহাসনে যখন বসি, তখন আমি ঐ–কেবল তোমরা যা বল—মহিমময় সম্রাট, যুদ্ধক্ষেত্রে যখন যুদ্ধ করি তখন আমি রক্ত-পাগল সেনানী, কিন্তু সুন্দর ফুলবনে আমিও সুন্দরের ধেয়ানী, হয়ত-বা কবিই!
- মীনকেতু, পৃ.১৫
- কেন ঘুম ভাঙালে প্রিয়
যদি ঠেলিবে পায়ে ।।
বৃথা বিকশিত কুসুম কি যাবে শুকায়ে।
একা বন-কুসুম ছিনু বনে ঘুমায়ে ॥
ছিল পাশরি' আপন বেভুল কিশোরী হিয়া
বধূর বিধুর যৌবন কেন দিলে জাগায়ে।
প্রিয় গো প্রিয়—
আকাশ বাতাস কেন ব্যথার রঙে তুমি
দিলে রাঙায়ে ॥- মেয়েটি, পৃ.১৬-১৭
- রাত্রে যখন কাছে ছিলে, তখন তুমি ছিলে কুমুদিনী, আমি ছিলুম চাঁদ। এখন দিন যখন এল, তখন আমি হলুম সূর্য্য, আমি এখন সূর্য্যমুখীর কমলের! যাও! চ'লে যাও! বিকশিত হয়েছ, এখন সারাদিন চোখ বু'জে থেকে সন্ধ্যেবেলায় ঝরে পড়ো ! যাও !
- মীনকেতু, পৃ.১৭
- চাঁদিনী রাতে কানন-সভাতে আপন হাতে গাঁথিলে মালা । নিবিড় সুখে সয়েছি বুকে তোমার হাতের সূচীর জ্বালা ॥
- মালা, পৃ.১৮
- ফুল ফুটলে ওকে যেমন মালা গেঁথে সার্থক করৃতে হয়, তেমনি রাত্রিশেষে সে বাসিমালা ফেলেও দিতে হয় !
- মীনকেতু, পৃ.১৯
- তোমাদের দেবতার মন্দির থেকে ফেরবার পথে ঐ অপদেবতাকে দেখলে ওকেও নমস্কার কর্তে ভুলিনে কৃষ্ণা!ওর বাকা চোখ তোমার সত্যের সোজা চোখের চেয়ে অনেক বেশী সুন্দর।
- মীনকেতু, পৃ.২১
- [মন্দালসার উদ্দেশ্যে] আহা রাগ করো কেন সুন্দরী, মাঝে মাঝে পুণ্য ক'রে পাপেরও মুখ বদলে নিতে হয়, এসব পুণ্যাত্বারা যখন বাসি হয়ে উঠবেন তখন তোমারই দুয়ারে আবার যাব।
- মীনকেতু, পৃ.২১
- ভোলো ভোলো রাতের স্বপন,
প্রভাতে আনো নব জীবন !
শতদলে আঁখি-জলে করো গোপন,
হায় বেদনা ভরে কার তরে
বৃথাই ধেয়ালি ॥- কাকলি ও সখীরা, পৃ.২২
- আমি দ্বীপশিখা নই সম্রাট, আমি কৃষ্ণা, নিশিথিনী।
- কৃষ্ণা, পৃ.২৩
- ওই সূর্য্য উঠছে, ওই সূর্য্য-ও যেন দুঃখের, জরার প্রতীক। ওর খরতাপে অশ্রু শুকায়, ফুল ঝরে, তরুণী উষার গালের লালি যায় ম্লান হয়ে, রাতের চাঁদ হ'য়ে ওঠে দীপ্তিহীন।
- মীনকেতু, পৃ.২৪
- আকাশের দেবী ও মাটীর মানুষে যখন নিরিবিলি ছুটো কথা কওয়ার জন্যে তে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে তখন সব চেয়ে মুস্কিল হয় ত্রিশক্কুর। লজ্জার দায় এড়াতে বেচারা স্বর্গেও উঠে যেতে পারে না, পৃথিবীতেও নেমে আসতে পারে না!
- কবি, পৃ.২৫
সংলাপ
সম্পাদনা- মীনকেতু: ...কিন্তু এসেছ যখন, গায়ে একটু ফুলেল্ হাওয়ার ছোঁয়াচ না-হয় লাগিয়েই গেলে! ওঃ, ভু'লে গিয়েছিলুম, ওতে বোধ হয় তোমার মন্ত্রীত্বের মুখোসটা খু'লে কৃষ্ণার মুখোস বেরিয়ে পড়বে! রাত্রির আবরণ খুলে চাঁদের আভা ফুটে উঠবে।
- কৃষ্ণা: (ধীর স্থির কণ্ঠে) সম্রাটের কি এটা জানা উচিত নয়, যে, তাঁর সাম্রাজ্যের প্রধান মন্ত্রীর সাথে এই নটীদের সামনে এই ব্যবহার আমাদের সকলেরই মহিমাকে খর্ব্ব করে!
- মীনকেতু:দেখ কৃষ্ণা আমি তরুণীদের কাছে কিছুতেই গম্ভীর হ'তে পারি নে। সুন্দরের কাছে রাজমহিমা দেখানোর মত হাসির জিনিষ আর-কিছু কি আছে? ধর, এই ফোটা ফুলের আর ওই সব উনুখ যৌবনা কিশোরীদের কাছে এমন সুন্দর সকালটা যদি রাজ্যের কথা ক'য়ে কাটিয়ে দিই—ও কি কৃষ্ণা, হাস্ছ?
- কৃষ্ণা: মার্জ্জনা করৃবেন সম্রাট্! আমিও আপনার ঐ আনন্দ হাসির তরঙ্গে মাঝে মাঝে তেসে যাই, ভুলে যাই আপনি আমাদের মহিমান্বিত সম্রাট, আর আমি তাঁর প্রধান মন্ত্রী। (দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া) মনে হয় আপনি আমার সেই ভুলে- যাওয়া দিনের শৈশব-সাথী !
- কৃষ্ণা: এতদিন ধ'রে ত তোমায় দেখেছি, তবু যেন তোমায় বুঝতে পারলুম না। আকাশের চাঁদের মতই তুমি সুদূর, অমনি জ্যোৎস্নায় কলঙ্কে মাখামাখি।
- মীনকেতু: তবুও ওই সুদূর কলঙ্কী-ই ত পৃথিবীর সাত সাগরকে দিবারাত্রি জোয়ার-ভাটার দোল খাওয়ায় !
- কৃষ্ণা: আচ্ছা মীনকেতু। তুমি কখনো৷ কাউকে ভালো- বেসেছিলে-মনে পড়ে ?
- মীনকেতু: (হাসিয়া) চাঁদ কাকে ভালোবাসে কৃষ্ণা?
- কৃষ্ণা: ও কলঙ্কী, ও হয়ত কাউকেই ভালোবাসে না।
- মীনকেতু: (হাততালি দিয়া) ঠিক বলেছ কৃষ্ণা, ওই কলঙ্কী- কেই সবাই ভালোবাসে, ও কাউকে ভালোবাসে না ।
- কৃষ্ণা: উঃ! আর আমি থাকতে পারছিনে! মীনকেতু ! তুমি কি?
- মীনকেতু: হা, ওই ওর নিয়তি। রাত্রের বাসিফুলকে রাত্রি- শেষেও যে আঁকড়ে প'ড়ে থাকে, তার সহার-সম্বল ত নেই-ই, তার যৌবনও ম'রে গেছে।
- কৃষ্ণা: নিষ্ঠুর! তোমার কি হৃদয় ব'লে—মনুষ্যত্ব ব'লে কিছু নেই?
- মীনকেতু: (হাসিয়া) আমি মনুষ্যত্বের পূজা করি না কৃষ্ণা ! আমি যৌবনের পুজারী! ফুল আর হৃদয় দ'লে চলাই আমার ধর্ম্ম।
- কৃষ্ণা: তোমায় দেখে বুঝতে পারি মীনকেতু, কেন শাস্ত্রে বলে পাপের দেবতা মারের চেয়ে সুন্দর এ বিশ্বে কেউ নেই।
- মীনকেতু: (হাসিয়া কৃষ্ণার গালে তর্জ্জনী দিয়া মৃদু আঘাত করিতে করিতে) ঠিক বলেছ কৃষ্ণা, মারের চেয়ে, মিথ্যার চেয়ে, মায়ার চেয়ে কি সুন্দর কিছু আছে? চাঁদে কলঙ্ক আছে বলেই ত চাঁদ এত আকর্ষণ করে; তোমার কপালের ঐ কালো টিপটাই ত তোমার মুখের সমস্ত লাবণ্যকে হার মানিয়েছে। রামধনু মিথ্যা বলেই ত অত সুন্দর! যৌবন ভুল করে পাপ করে বলেই ত ওর উপর এত লোভ, ও এত সুন্দর !
- মীনকেতু: এই ফুলফোটার গান শুনে বালিকা কিশোরী হয়, তরুণী যৌবন পায়, রাতের কুঁড়ি দিনের ফুল হ'য়ে হাসে, এই আমার রাজ্যের জাতীয় সঙ্গীত !
- কবি: ঠিক রাজ্যের নয় সম্রাট্, এ আমাদের যৌবনের জাতীয় সঙ্গীত
- মীনকেতু: কিন্তু কৃষ্ণা, তুমি যদি নিশিথিনীই হও, আমি ত কলঙ্কী চাঁদ। চাঁদ উঠলে ত নিশিধিনীর মুখ অমন মন্ত্রী মুখো হ'য়ে থাকে না!
- কৃষ্ণা: কিন্তু আজকের এ চাঁদ দ্বিতীয়ার চাঁদ সম্রাট! এ চাঁদের কিরণে নিশিখিনীর মুখে যে হাসি ফুটে ওঠে, তা কান্নার চেয়েও করুণ।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনাউইকিপিডিয়ায় আলেয়া সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ রয়েছে।