আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (সাহিত্যিক)

বাঙালি লেখক

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (জন্ম: ৭ সেপ্টেম্বর ১৯২০ — মৃত্যু: ৪ মে ১৯৮৯) একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক।খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক। তার সৃষ্ট বিখ্যাত বাঙালী কাল্পনিক চরিত্র পিনডিদা। তিনি প্রায় দু-শোর মতো বই লিখেছেন। তার মধ্যে এক-শো কুড়ি-পঁচিশটি উপন্যাস। বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় তার অনেক বই অনূদিত হয়েছে। শিশু সাহিত্য জগতেও তিনি আদৃত এক লেখক। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে - পঞ্চতপা, চলাচল, কাল তুমি আলেয়া, অন্য নাম জীবন, অপরিচিতের মুখ, আনন্দরূপ, আবার আমি আসবো, আরো একজন ইত্যাদি।

  • শ্রীমতী সেনের 'সাত পাকে বাঁধা' বিশ্বখ্যাতি অর্জন করল কিন্তু অর্চনাই কি তাঁর জীবনে শ্রেষ্ঠতম অভিনয় যা বিশ্বের লোকরা দেখল? 'দীপ জ্বেলে যাই' তে শ্রীমতী সেনের সুষমাদীপ্ত অভিনয়ে সেই জীবনবেদনা আত্মার উপর কি গভীর ছাপ রেখে যেতে পারে তা বিশ্ব বিচারকরা দেখতে পেলেন না। অর্চনা আর নার্স রাধা মিত্র কে পাশাপাশি দাঁড় করাতেই হবে যদি সুচিত্রা সেনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় বলতে হয়। যা আর কোনও অভিনেত্রী পারতেন না।
  • কথা বলো বাবা, বাবা! কথা বলো...” ঠোঁট দুটো নড়ল শুধু। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে নীল। কিন্তু হাসি হাসি মুখ। ডান চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে আসা ঠিক এক ফোঁটা জল। শেষ বারের জন্য কথা বলতে চাওয়া আমার বাবা চলে গেল।
  • উপেক্ষায়, অবজ্ঞায় বাবা বোধহয় অভ্যস্তই ছিল। বলত, “কী যায় আসে! বিয়ের সময় বাবা যেভাবে মেয়েকে সাজিয়ে-গুছিয়ে পরের হাতে তুলে দেয়, আমিও সেটাই করেছি। বিয়ের পর মেয়ে তো পরেরই হয়ে যায়।’ প্রত্যেকটি গল্প-উপন্যাস ছিল বাবার কাছে তাঁর ‘মেয়ে’।
  • দিনের পর দিন দেখেছি বড় বড় প্রযোজক-পরিচালক স্ক্রিপ্ট করে নিয়ে এসেছেন। একবার চোখ বুলিয়ে ‘কিসসু হয়নি’ বলে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে বাবা। নিজে বসে গিয়েছে কলম হাতে। তার পরেও পর্দায় নাম দূরে থাক, কৃতজ্ঞতাস্বীকারটাও যে পেয়েছে, তাও না। তাতে হেলদোল ছিল কি? অভিমান? রাগ? অপমানবোধ? কোনও দিন বুঝিনি। শুধু মাঝে মধ্যে এটুকু বলতে শুনেছি, “চালের কাঁকর বাছার মতো করে এক-একটা অক্ষর ধরে ধরে লিখেছি। আগাপাস্তলা ঝেড়ে মুছে স্ক্রিপ্ট করেছি। তবে না ছবিগুলো হিট হয়েছে।
  • একবারের কথা বলি। বাবা তখন সংগ্রাম-করা উঠতি লেখক। রোজগার নামমাত্র। বম্বে থেকে শশধর মুখার্জির প্রোডাকশন-হাউসে স্ক্রিপ্ট রাইটার বা চিত্রনাট্য লেখক হওয়ার ডাক এল। মোটা মাসমাইনে। গাড়িবাড়ি সমেত বিলাসী অফার। ফিরিয়ে দিয়েছিল বাবা। সাফ কথা, “আমি কলম ধরেছি সাহিত্যিক হব বলে। ফরমাইসি স্ক্রিপ্ট লেখার জন্য নয়। নিজের লেখা গপ্পো-উপন্যাসে সেটা করে দিই, আমার লেখা বলে, ব্যস।”
  • সেই শুরু। তারপর থেকে হেমন্তকাকু আমাদের প্রতাপাদিত্যের বাড়িতে নিজে তো আসতই, বম্বে-কলকাতার প্রায় সব নামীদামি গায়ক-গায়িকাকে ধরে নিয়ে আসত আশুতোষের কালরোগে ধরা একমাত্র ছেলে, গানপাগল জয়কে গান শোনাতে। আমাদের ঘরে বসে লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, কিশোরকুমার, মান্না দে’কে গাইতে শুনেছি। এসেছেন সুনন্দা পট্টনায়ক, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। একের পর এক গান করে গেছেন শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, নির্মলা মিশ্র, হৈমন্তী শুক্ল, বনশ্রী সেনগুপ্ত...! কত নাম বলব...!
  • লেখার জন্য নিজের খাটের ওপর একটা জলচৌকি, এ-ফোর সাইজের রাইটিং প্যাড আর নিজস্ব কয়েকটা কলম ব্যস, আর কিচ্ছু না। তাতেই যা হওয়ার হয়েছে। সরস্বতী পুজোর দিন দেখতাম, প্রতি বছর একটা না একটা গল্প বা উপন্যাসের লাইন লিখত ওই জলচৌকি টেনে নিয়ে। ওটাই ছিল হয়তো বা বাবার অর্ঘ্য। অঞ্জলি দিত পেট পুরে খেয়ে দেয়ে।
  • পুত্রের মারণ-রোগ ধরা পড়ল। মুখোপাধ্যায় বংশের সাড়ে তিনশো বছরের নৃসিংহ নারায়ণ শিলা মাথায় নিয়ে বাবাকে ঠাকুরঘরে বসে থাকতে দেখেছি। রাতের পর রাত। দু’চোখ বেয়ে নামছে দরদর জলের ধারা।
  • এমনই এক নিশুত রাতে বাবা বলেছিলেন, ‘যখন আমি হতাশায় পাগল-পাগল, প্রায় সমস্ত লেখা ফেরত আসছে ছাইভস্ম বলে, ভাবতাম নাম-যশ-অর্থ-সাফল্যই বোধহয় শেষ কথা। ঠাকুরের কাছে তাই চাইতাম। আর আজ যখন তার সব পেলাম...! কী হল বলতে পারিস?’ বুজে আসত বাবার গলা। ফোঁপাতে ফোঁপাতে থেমে থেমে বলত, ‘কখনও এই ভুল করিস না, ঈশ্বরের কাছে চাইতে হলে চাইবি শান্তি, আনন্দ আর তৃপ্তি। এর বাইরে বাকি সব ফাঁকি, সব ফাঁকা।’ খুব কঠিন সময়েও সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে যে দু’জন বারবার তাকে কাজের দিকে ঠেলে দিয়েছে, তাদের প্রথমজন তার নিজের মা, অন্যজন আমার মা মমতা মুখোপাধ্যায়।
  • পারবেন, সেক্স ছাড়া শরীর ছাড়া যৌনতার গন্ধ ছাড়া একটাও রোম্যান্টিক লেখা লিখতে? সঙ্গে সঙ্গে আমার বাবার জবাব, ‘পারব। লিখে সব থেকে আগে আপনাকেই পড়াব।’ এর পরই বাবা লিখল, ‘মনমধুচন্দ্রিকা’। যেখানে নায়ক-নায়িকা শরীরী হওয়া দূরে থাক, নিজেদের মধ্যে একটা কথাও বলেনি। লেখা পড়ে সমরেশ বসু বলেছিলেন, ‘আনথিংকেবল্! কনগ্র্যাচুলেশনস্।’ তারপর, ‘আমারও কেবল একটা কথাই বলার আছে ... আমিও পারব না... তবে আপনার মতো বলতে পারছি না ‘লিখবও না’। দুই বন্ধুর উষ্ণ হাতের তালু তখন একে অপরের কাছে বন্দি।

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (সাহিত্যিক) সম্পর্কে উক্তি

সম্পাদনা
  • আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনযুদ্ধ অমানুষিক। শুরুর জীবন থেকেই এত আঘাত, বিশেষত রোগভোগ খুবই সমস্যা তৈরি করে। প্রথমে নিজের চোখের সমস্যা থেকে পড়াশোনায় বাধা। তার পরেও তিনি যৌথ পরিবারে সকলের গঞ্জনা অতিক্রম করে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। কিন্তু পাকা চাকরি তাঁর জীবনে ছিল না। তাই বিয়ে করার জন্য আদর্শ পাত্র তিনি হয়তো ছিলেন না সমাজের চোখে। কিন্তু তাঁকেই ভরসা করেছিলেন লখনউয়ের মেয়ে মমতা মুখোপাধ্যায়। বাড়ির আপত্তি অগ্রাহ্য করে কলকাতায় এসেছিলেন কোনও এক স্কুলে হিন্দি পড়াতে। কলকাতায় এসে তাঁর বিয়ের যোগাযোগ হল স্বল্প রোজগেরে আশুতোষের সঙ্গে।
  • লেখার জন্য নিজের খাটের ওপর একটা জলচৌকি, এ-ফোর সাইজের রাইটিং প্যাড আর নিজস্ব কয়েকটা কলম। ব্যস, আর কিচ্ছু না। তাতেই যা হওয়ার হয়েছে। সরস্বতী পুজোর দিন দেখতাম, প্রতি বছর একটা না একটা গল্প বা উপন্যাসের লাইন লিখত ওই জলচৌকি টেনে নিয়ে। ওটাই ছিল বাবার অর্ঘ্য। অঞ্জলি দিতেন পেট পুরে খেয়েদেয়ে।
  • বিশাল একান্নবর্তী কৃতী পরিবারের একমাত্র অ-কৃতী সেজো ছেলে আশুতোষের জন্যই আজ মুখোপাধ্যায় পরিবার বিখ্যাত। এটাও তাঁরই জয়।

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা