কালমৃগয়া
কালমৃগয়া হল ১৮৮২ খ্রীস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্ত্তৃক রচিত একটি বাংলা নাটক। এটি তাঁর লেখা দ্বিতীয় গীতিনাট্য। রবীন্দ্রনাথ বাল্মিকীকৃত রামায়ণের উপাখ্যান (রাজা দশরথ কর্তৃক অন্ধমুনির পুত্রবধ) অবলম্বনে নাটকটি রচনা করেন। তিনি বিলাতি সুুরকেও নিজস্ব ঢংয়ে মিশিয়ে নাটকটিকে মাধুর্যমন্ডিত করে তোলেন। তিনি বিলাত থেকে কলকাতায় ফিরে এসে এই গীতিনাট্যটি রচনা করেন।
উক্তি
সম্পাদনা- “লীলা। কাল সকালে উঠব মোরা
যাব নদীর কূলে_ শিব গড়িয়ে করব পুজো, আনব কুসুম তুলে।
ঋষিকুমার। মোরা ভোরের বেলা গাঁথব মালা, দুলব সে দোলায়, বাজিয়ে বাঁশি গান গাহিব বকুলের তলায়।
লীলা। না ভাই, কাল সকালে মায়ের কাছে নিয়ে যাব ধ'রে, মা বলেছে ঋষির সাজে সাজিয়ে দেবে তোরে!
ঋষিকুমার। সন্ধ্যা হয়ে এল যে ভাই, এখন যাই ফিরে_ একলা আছেন অন্ধ পিতা আঁধার কুটীরে।” — কালমৃগয়া, প্রথম দৃশ্য।
- “অন্ধ ঋষি।না না কাজ নাই, যেও না বাছা,--
গভীরা রজনী, ঘোর ঘন গরজে, তুই যে এ অন্ধের নয়নতারা। আর কে আমার আছে! কেহ নাই, কেহ নাই-- তুই শুধু রয়েছিস হৃদয় জুড়ায়ে-- তোরেও কি হারাব বাছা রে, সে ত প্রাণে স'বে না!
ঋষিকুমার। আমা-তরে অকারণে, ওগো পিতা, ভেবো না। অদূরে সরযূ বহে, দূরে যাব না। পথ যে সরল অতি, চপলা দিতেছে জ্যোতি, তবে কেন, পিতা, মিছে ভাবনা। অদূরে সরযূ বহে, দূরে যাব না।” — কালমৃগয়া, তৃতীয় দৃশ্য।
- “বনদেবীগণ। এই ঘোর আঁধার, কোথা রে যাস!
ফিরিয়ে যা, তরাসে প্রাণ কাঁপে! স্নেহের পুতুলি তুই, কোথা যাবি একা এ নিশীথে! কি জানি কি হবে, বনে হবি পথহারা!
ঋষিকুমার। না, কোরো না মানা, যাব ত্বরা। পিতা আমার কাতর তৃষায়, যেতেছি তাই সরযূনদীতীরে।
বনদেবীগণ। মানা না মানিলি, তবুও চলিলি, কি জানি কি ঘটে! অমঙ্গল হেন প্রাণে জাগে কেন, থেকে থেকে যেন প্রাণ কেঁদে ওঠে! রাখ্ রে কথা রাখ্, বারি আনা থাক্, যা ঘরে যা ছুটে! অয়ি দিগঙ্গনে, রেখো গো যতনে অভয়স্নেহছায়ায়! অয়ি বিভাবরী, রাখ বুকে ধরি ভয় অপহরি রাখ এ জনায়! এ যে শিশুমতি, বন ঘোর অতি-- এ যে একেলা অসহায়!” — কালমৃগয়া, চতুর্থ দৃশ্য।
- “শিকারীগণ। জয়তি জয় জয় রাজন্ বন্দি তোমারে,
কে আছে তোমা সমান। ত্রিভুবন কাঁপে তোমার প্রতাপে, তোমারে করি প্রণাম!
দশরথ। [শিকারীদের প্রতি] গহনে গহনে যা রে তোরা, নিশি ব'হে যায় যে! তন্ন তন্ন করি অরণ্য করী বরাহ খোঁজ্ গে! এই বেলা যা রে! নিশাচর পশু সবে এখনি বাহির হবে-- ধনুর্ব্বাণ নে রে হাতে, চল্ ত্বরা চল্। জ্বালায়ে মশাল আলো এই বেলা আয় রে! ” — কালমৃগয়া, পঞ্চম দৃশ্য।
- “শিকারীগণ। ঠাকুরমশয়, দেরি না সয়--
তোমার আশায় সবাই ব'সে। শিকারেতে হবে যেতে, মিহি কোমর বাঁধ ক'ষে! বন বাদাড় সব ঘেঁটেঘুঁটে, আমরা মরি খেটেখুটে, তুমি কেবল লুটেপুটে পেট পোরাবে ঠেসেঠুসে!
বিদূষক। কাজ কি খেয়ে, তোফা আছি-- আমায় কেউ না খেলেই বাঁচি! শিকার করতে যায় কে মরতে-- ঢুঁসিয়ে দেবে বরা' মোষে! ঢুঁ খেয়ে ত পেট ভরে না, সাধের পেটটি যাবে ফেঁসে।” — কালমৃগয়া, পঞ্চম দৃশ্য।
- “ঋষিকুমার।
কি দোষ করেছি তোমার, কেন গো হানিলে বাণ! একই বাণে বধিলে যে দুটি অভাগার প্রাণ! শিশু বনচারী আমি কিছুই নাহিক জানি-- ফল মূল তুলে আনি, করি সামবেদ গান! জন্মান্ধ জনক মম তৃষায় কাতর হয়ে রয়েছেন পথ চেয়ে_ কখন যাব বারি লয়ে। মরণান্তে নিয়ে যেও, এ দেহ তাঁর কোলে দিও-- দেখো, দেখো ভুলোনাকো, কোরো তাঁরে বারিদান! মার্জ্জনা করিবেন পিতা, তাঁর যে দয়ার প্রাণ!” — কালমৃগয়া, পঞ্চম দৃশ্য।
- “দশরথ। অজ্ঞানে কর হে ক্ষমা, তাত, ধরি চরণে--
কেমনে কহিব, শিহরি আতঙ্কে! আঁধারে সন্ধানি শর খরতর করী-ভ্রমে বধি তব পুত্রবর, গ্রহদোষে পড়েছি পাপপঙ্কে!
অন্ধ ঋষি। কি বলিলে, কি শুনিলাম, একি কভু হয়! এই যে জল আনিবারে গেল সে সরযূতীরে-- কার সাধ্য বধে, সে যে ঋষির তনয়! সুকুমার শিশু সে যে, স্নেহের বাছা রে! আছে কি নিষ্ঠুর কেহ বধিবে যে তারে! না না না, কোথা সে আছে-- এনে দে আমার কাছে, সারা নিশি জেগে আছি বিলম্ব না সয়! এখনো যে নিরুত্তর-- নাহি প্রাণে ভয়! রে দুরাত্মা-- কী করিলি--
পুত্রব্যসনজং দুঃখং
যদেতন্মম সাংপ্রতম্।
এবং ত্বং পুত্রশোকেন
রাজন্ কালং করিষ্যসি॥” — কালমৃগয়া, ষষ্ঠ দৃশ্য।
- “অন্ধ ঋষি। যাও রে অনন্তধামে মোহ মায়া পাশরি
দুঃখ আঁধার যেথা কিছুই নাহি। জরা নাহি, মরণ নাহি, শোক নাহি যে লোকে, কেবলি আনন্দস্রোত চলিছে প্রবাহি! যাও রে অনন্তধামে, অমৃতনিকেতনে, অমরগণ লইবে তোমা উদারপ্রাণে! দেব-ঋষি, রাজ-ঋষি, ব্রহ্ম-ঋষি যে লোকে ধ্যানভরে গান করে এক তানে! যাও রে অনন্তধামে জ্যোতিময় আলয়ে, শুভ্র সেই চিরবিমল পুণ্য কিরণে-- যায় যেথা দানব্রত, সত্যব্রত, পুণ্যবান, যাও বৎস, যাও সেই দেবসদনে!” — কালমৃগয়া, ষষ্ঠ দৃশ্য।
চরিত্রসমূহ
সম্পাদনা- অন্ধ ঋষি
- ঋষিকুমার
- দশরথ
- লীলা
- বনদেবীগণ (৪ জন)
- বনদেবতা
- শিকারীগণ (৩ জন)
- বিদূষক