জিহাদ

ইসলাম ধর্মের একটি ইবাদত

জিহাদ (আরবি: جهاد‎), যার অর্থ সংগ্রাম; কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য লাভের জন্য সমগ্র শক্তি নিয়োগ করাকে বোঝানো হয়। এর আভিধানিক অর্থ পরিশ্রম,সাধনা,কষ্ট, চেষ্টা ইত্যাদি। তবে সচরাচর ইসলামী পারিভাষিক অর্থে 'জিহাদ' কথাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কুরআনে জিহাদের কথা ৪১ বার উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে "আল্লাহের পথে সংগ্রাম করা" অর্থে 'জিহাদ' কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। জিহাদের সাথে জড়িত ব্যক্তিকে মুজাহিদ বলা হয়। জিহাদকে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসাবে গণ্য করা হয়।

প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ বার্নার্ড লুইসের মতে কুরআন ও হাদীসের অধিকাংশ জায়গাতেই জিহাদ শব্দটি ধর্মযুদ্ধ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইসলামী পণ্ডিত ইয়াহিয়া ইবন শরাফ আল-নাদভী বলেছেন, (জিহাদ অর্থ) "সমাজের সবার সামগ্রিক দায়িত্ব হলো ন্যায্য প্রতিবাদে অংশ নেয়া, ধর্মের সমস্যা দূর করা, স্রষ্টার আইনের কথা জানা, ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা ও অন্যায়কে দূর করা। কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী স্থানভেদে জিহাদ তিন রূপ হতে পারেঃ (ক) পাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য স্বীয় কৃপ্রবৃত্তির বিরূদ্ধে জিহাদ, (খ) মুসলিম সমাজকে উন্নয়নের সংগ্রাম, এবং (গ) যুদ্ধক্ষেত্রে সংগ্রাম।

জিহাদ’ অর্থ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। শারঈ পরিভাষায় ‘জিহাদ’ হ’ল সমাজে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর রাস্তায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা যার চূড়ান্ত রূপ। জিহাদের উদ্দেশ্য হ’ল মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা এবং মানুষে মানুষে সাম্য ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

 وَ قَاتِلُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ الَّذِیۡنَ یُقَاتِلُوۡنَکُمۡ وَ لَا تَعۡتَدُوۡا ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ الۡمُعۡتَدِیۡنَ ﴿۱۹۰﴾
  • আর তোমরা আল্লাহর রাস্তায় তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।
    • সূরাঃ আল-বাকারা: আয়াতঃ ১৯০
اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ قِیۡلَ لَهُمۡ کُفُّوۡۤا اَیۡدِیَکُمۡ وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ ۚ فَلَمَّا کُتِبَ عَلَیۡهِمُ الۡقِتَالُ اِذَا فَرِیۡقٌ مِّنۡهُمۡ یَخۡشَوۡنَ النَّاسَ کَخَشۡیَۃِ اللّٰهِ اَوۡ اَشَدَّ خَشۡیَۃً ۚ وَ قَالُوۡا رَبَّنَا لِمَ کَتَبۡتَ عَلَیۡنَا الۡقِتَالَ ۚ لَوۡ لَاۤ اَخَّرۡتَنَاۤ اِلٰۤی اَجَلٍ قَرِیۡبٍ ؕ قُلۡ مَتَاعُ الدُّنۡیَا قَلِیۡلٌ ۚ وَ الۡاٰخِرَۃُ خَیۡرٌ لِّمَنِ اتَّقٰی ۟ وَ لَا تُظۡلَمُوۡنَ فَتِیۡلًا ﴿۷۷﴾
  • তুমি কি তাদেরকে দেখনি যাদেরকে বলা হয়েছিল, তোমরা তোমাদের হাত গুটিয়ে নাও এবং সালাত কায়েম কর ও যাকাত প্রদান কর? অতঃপর তাদের উপর যখন লড়াই ফরয করা হল, তখন তাদের একদল মানুষকে ভয় করতে লাগল আল্লাহকে ভয় করার অনুরূপ অথবা তার চেয়ে কঠিন ভয়। আর বলল, ‘হে আমাদের রব, আপনি আমাদের উপর লড়াই ফরয করলেন কেন? আমাদেরকে কেন আরো কিছুকালের অবকাশ দিলেন না’? বল, ‘দুনিয়ার সুখ সামান্য। আর যে তাকওয়া অবলম্বন করে তার জন্য আখিরাত উত্তম। আর তোমাদের প্রতি সূতা পরিমাণ যুলমও করা হবে না’।
    • সূরাঃ আন-নিসা: আয়াতঃ ৭৭
اُذِنَ لِلَّذِیۡنَ یُقٰتَلُوۡنَ بِاَنَّهُمۡ ظُلِمُوۡا ؕ وَ اِنَّ اللّٰهَ عَلٰی نَصۡرِهِمۡ لَقَدِیۡرُۨ ﴿ۙ۳۹﴾
  • যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে, যাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে। কারণ তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দানে সক্ষম।
    • সূরাঃ আল-হজ্জ: আয়াতঃ ৩৯
 وَ قٰتِلُوۡهُمۡ حَتّٰی لَا تَکُوۡنَ فِتۡنَۃٌ وَّ یَکُوۡنَ الدِّیۡنُ لِلّٰهِ ؕ فَاِنِ انۡتَهَوۡا فَلَا عُدۡوَانَ اِلَّا عَلَی الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۱۹۳﴾
  • ফিতনা দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত এবং দীন আল্লাহর জন্য নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, অতঃপর যদি তারা বিরত হয় তবে যালিমদের উপরে ছাড়া কোনও প্রকারের কঠোরতা অবলম্বন জায়িয হবে না।
    • সূরাঃ আল-বাকারা: আয়াতঃ ১৯৩
 وَ قَاتِلُوۡهُمۡ حَتّٰی لَا تَکُوۡنَ فِتۡنَۃٌ وَّ یَکُوۡنَ الدِّیۡنُ کُلُّهٗ لِلّٰهِ ۚ فَاِنِ انۡتَهَوۡا فَاِنَّ اللّٰهَ بِمَا یَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ ﴿۳۹﴾
  • তোমরা সদা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিতনার অবসান হয় এবং দীন সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। আর তারা যদি ফিতনা ও বিপর্যয় সৃষ্টি হতে বিরত থাকে তাহলে তারা কি করেছে তা আল্লাহই দেখবেন।
    • সূরাঃ আল-আনফাল: আয়াতঃ ৩৯
اِلَّا تَنۡصُرُوۡهُ فَقَدۡ نَصَرَهُ اللّٰهُ اِذۡ اَخۡرَجَهُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ثَانِیَ اثۡنَیۡنِ اِذۡ هُمَا فِی الۡغَارِ اِذۡ یَقُوۡلُ لِصَاحِبِهٖ لَا تَحۡزَنۡ اِنَّ اللّٰهَ مَعَنَا ۚ فَاَنۡزَلَ اللّٰهُ سَکِیۡنَتَهٗ عَلَیۡهِ وَ اَیَّدَهٗ بِجُنُوۡدٍ لَّمۡ تَرَوۡهَا وَ جَعَلَ کَلِمَۃَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوا السُّفۡلٰی ؕ وَ کَلِمَۃُ اللّٰهِ هِیَ الۡعُلۡیَا ؕ وَ اللّٰهُ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ ﴿۴۰﴾
  • যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন যখন কাফিররা তাকে বের করে দিল, সে ছিল দু’জনের দ্বিতীয়জন। যখন তারা উভয়ে পাহাড়ের একটি গুহায় অবস্থান করছিল, সে তার সঙ্গীকে বলল, ‘তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। অতঃপর আল্লাহ তার উপর তাঁর পক্ষ থেকে প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাকে এমন এক সৈন্য বাহিনী দ্বারা সাহায্য করলেন যাদেরকে তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফিরদের বাণী অতি নিচু করে দিলেন। আর আল্লাহর বাণীই সুউচ্চ। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান।
    • সূরাঃ আত-তাওবা: আয়াতঃ ৪০
  • হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর পথে জিহাদও নয় কি? তিনি বলেন, ‘না, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে ওই ব্যক্তির কথা ভিন্ন, যে তার জান-মাল নিয়ে জিহাদে বের হয়েছে এবং কোনো একটি নিয়েও ফিরে আসেনি।’ (অর্থাৎ সে শহীদ হয়ে যায়)।
    • (আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৩৮, তিরমিজি, হাদিস : ৭৫৭)
  • আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক সালাতের পরে আরেক সালাতের জন্য আপেক্ষমাণ ব্যক্তি সেই অশ্বারোহী সৈনিকের মতো, আল্লাহর পথে যার কোমরে ঘোড়ার লাগাম শক্ত করে বাঁধা আছে। ফেরেশতামণ্ডলী তার জন্য রহমত প্রার্থনা করতে থাকেন, যতক্ষণ না তার অজু টুটে যায় অথবা মুসল্লা ছেড়ে উঠে পড়ে। আর সে যেন সীমান্ত প্রহরার মহান কাজে নিয়োজিত।
    • (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৮৬২৫)
  • রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার মা-বাবার কেউ জীবিত আছেন কি?’ লোকটি বলল, হ্যাঁ। বরং দুজনেই বেঁচে আছেন। আমি তাদের উভয়কে ক্রন্দনরত অবস্থায় ছেড়ে এসেছি। রাসুল (সা.) বললেন, ‘এর পরও তুমি আল্লাহর কাছে পুরস্কার আশা করো? লোকটি বলল, হ্যাঁ। তিনি বলেন, ‘তুমি তোমার মা-বাবার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের সর্বোত্তম সাহচর্য দান করো এবং তাদের কাছেই জিহাদ করো।
    • (মুসলিম, হাদিস : ২৫৪৯)
  • সহায়-সম্বলহীন মিসকিন ও স্বামীহারা বিধবা নারীদের সহযোগিতার মাধ্যমে একজন মুসলিম আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মতো মর্যাদা লাভ করতে পারে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বিধবা ও মিসকিনদের ভরণ-পোষণের জন্য চেষ্টারত ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদ অথবা সারা দিন সিয়াম পালনকারী ও সারা রাত (তাহাজ্জুদ) সালাত আদায়কারীর সমান সওয়াবের অধিকারী।
    • (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৬৯, নাসাঈ, হাদিস : ২৫৭৭)
  • হজ একটি ফরজ ইবাদত। কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত। পাশাপাশি এর মাধ্যমে জিহাদের নেকিও অর্জিত হয়। শিফা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলল, আমি আল্লাহর পথে জিহাদ করতে চাই। তখন তিনি বলেন, ‘আমি কি তোমাকে এমন এক জিহাদের সন্ধান দেব, যাতে কোনো কষ্ট নেই?’ লোকটি বলল, অবশ্যই। তিনি বলেন, ‘বায়তুল্লাহর হজ করা।
    • (তাবারানি, মুজামুল কাবির, হাদিস : ৭৯২)
  • এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে বলল, আমি ভীরু ও দুর্বল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, ‘চলো! এমন একটি জিহাদে যাই, যে জিহাদের পথে কোনো কাঁটা নেই। আর তা হলো হজ করা।
    • (সহিহুল জামে, হাদিস : ৭০৪৪)
  • অত্যাচারী শাসকের সামনে হক কথা বলা এবং তাদের সৎ কাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ করা অন্যতম জিহাদ। যারা এই কাজ করতে গিয়ে নিহত হয়, তারা শহীদের মর্যাদা লাভ করে। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শহীদদের সর্দার হলো হামজাহ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব এবং ওই ব্যক্তি, যে কোনো অত্যাচারী শাসকের কাছে গিয়ে তাকে সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে। ফলে তাকে হত্যা করা হয়।
    • (সহিহুত তারগিব, হাদিস : ২৩০৮, সহিহুল জামে, হাদিস : ৩৬৭৫)
  • শহীদের মর্যাদা লাভের অন্যতম উপায় হলো সব সময় শহীদি মৃত্যু কামনা করা। যার অন্তরে শাহাদাতের তামান্না থাকে, সে নিজ গৃহে মৃত্যুবরণ করলেও শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবে। সাহল ইবনে হুনাইফ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর কাছে শাহাদাত প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদায় অভিষিক্ত করবেন, যদিও সে নিজ বিছানায় মৃত্যুবরণ করে।
    • (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫২০, তিরমিজি, হাদিস : ১৬৫৩
  • এমন কিছু বিপদ-আপদ ও রোগ-ব্যাধি আছে, যারা সেই বিপদ-আপদ ও রোগে মৃত্যুবরণ করে, হাদিসের ভাষ্য মতে তারা শহীদের মর্যাদা লাভ করতে পারে। জাবের ইবনে আতিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তি ছাড়াও আরো সাত শ্রেণির শহীদ আছে। তারা হলো—
  1. মহামারিতে মৃত (মুমিন) ব্যক্তি,
  2. পানিতে ডুবে মৃত ব্যক্তি,
  3. ‘জাতুল জাম্ব’ নামক (মেয়েলি) কঠিন রোগে মৃত ব্যক্তি,
  4. (কলেরা, ডায়রিয়া বা অনুরূপ) পেটের পীড়ায় মৃত ব্যক্তি,
  5. আগুনে পুড়ে মৃত ব্যক্তি,
  6. ধসে চাপা পড়ে মৃত ব্যক্তি,
  7. গর্ভাবস্থায় মৃত নারী।
  • (আবু দাউদ, হাদিস : ৩১১১)

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা