তাসের দেশ (নাটক)
তাসের দেশ হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক রচিত একটি বাংলা নাটক। এটি ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজেরই লেখা "একটা আষাঢ়ে গল্প" নামক ছোটোগল্পের কাহিনী অবলম্বনে এই নাটকটি রচনা করেন। এই নাটকটিতে ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষের মুুক্তির জন্যে রবীন্দ্রনাথ একজন মুক্তিদূতের আহ্বান করেছেন।
উক্তি
সম্পাদনা- “কল্যাণীয় শ্রীমান সুভাষচন্দ্র,
স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ ক'রে তোমার নামে 'তাসের দেশ' নাটিকা উৎসর্গ করলুম।” — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্দেশ্যে।
- “রাজপুত্র। আর তো চলছে না, বন্ধু।
সদাগর। কিসের চাঞ্চল্য তোমার, রাজকুমার।
রাজপুত্র। কেমন ক'রে বলব। কিসের চাঞ্চল্য বলো দেখি ঐ হাঁসের দলের, বসন্তে যারা ঝাঁকে ঝাঁকে চলেছে হিমালয়ের দিকে।
সদাগর। সেখানে যে ওদের বাসা।
রাজপুত্র। বাসা যদি, তবে ছেড়ে আসে কেন। না না, ওড়বার আনন্দ, অকারণ আনন্দ।” — তাসের দেশ, প্রথম দৃশ্য।
- “সদাগর। রানীমা, উনি মরীচিকাকে জাল ফেলে ধরবেন, উনি রূপকথার দেশের সন্ধান পেতে চান।
মা। সে কী কথা। আবার ছেলেমানুষ হতে চাস নাকি।
রাজপুত্র। হাঁ, মা, বুড়োমানুষির সুবুদ্ধি-ঘেরা জগতে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছে।
মা। বুঝেছি, বাছা, আসলে, তোমার অভাবটা অভাবেরই অভাব। পাওয়া জিনিসে তোমার বিতৃষ্ণা জন্মেছে। তুমি চাইতে চাও, আজ পর্যন্ত সে সুযোগ তোমার ঘটে নি।
রাজপুত্র। (গান) আমার মন বলে, "চাই চাই গো যারে নাহি পাই গো।' সকল পাওয়ার মাঝে আমার মনে বেদন বাজে, "নাই নাই নাই গো।' হারিয়ে যেতে হবে, ফিরিয়ে পাব তবে, সন্ধ্যাতারা যায় যে চলে ভোরের তারায় জাগবে ব'লে, বলে সে, "যাই যাই যাই গো।'
মা। বাছা, তোমাকে ধরে রাখতে গেলেই হারাব। তুমি বইতে পারবে না আরামের বোঝা, সইতে পারবে না সেবার বন্ধন। আমি ভয় ক'রে অকল্যাণ করব না। ললাটে দেব শ্বেতচন্দনের তিলক, শ্বেত উষ্ণীষে পরাব শ্বেতকরবীর গুচ্ছ। যাই কুলদেবতার পুজো সাজাতে। সন্ধ্যার সময় আরতির কাজল পরাব চোখে। পথে দৃষ্টির বাধা যাবে কেটে।” — তাসের দেশ, প্রথম দৃশ্য।
- “ রাজপুত্র । এক ডাঙা থেকে দিলেম পাড়ি, তরী ডুবল মাঝ সমুদ্রে, ভেসে উঠলেম আর-এক ডাঙায়। এতদিন পরে মনে হচ্ছে, জীবনে নতুন পর্ব শুরু হল।
সদাগর। রাজপুত্র, তুমি তো কেবলই নতুন নতুন করে অস্থির হলে। আমি ভয় করি ঐ নতুনকেই। যাই বল, বন্ধু, পুরোনোটা আরামের।
রাজপুত্র। ব্যাঙের আরাম এঁদো কুয়োর মধ্যে। এটা বুঝলে না, উঠে এসেছি মরণের তলা থেকে। যম আমাদের ললাটে নতুন জীবনের তিলক পরিয়ে দিলেন।
সদাগর। রাজতিলক তোমার ললাটে তো নিয়েই এসেছ জন্মমুহূর্তে।
রাজপুত্র। সে তো অদৃষ্টের ভিক্ষেদানের ছাপ। যমরাজ মহাসমুদ্রের জলে সেটা কপাল থেকে মুছে দিয়ে হুকুম করেছেন, নতুন রাজ্য নতুন শক্তিতে জয় করে নিতে হবে, নতুন দেশে।” — তাসের দেশ, দ্বিতীয় দৃশ্য
- “সদাগর।তোমাদের উৎপত্তি কোথা থেকে।
ছক্কা। ব্রহ্মা হয়রান হয়ে পড়লেন সৃষ্টির কাজে। তখন বিকেল বেলাটায় প্রথম যে হাই তুললেন, পবিত্র সেই হাই থেকে আমাদের উদ্ভব।
পঞ্জা। এই কারণে কোনো কোনো ম্লেচ্ছভাষায় আমাদের তাসবংশীয় না ব'লে হাইবংশীয় বলে।
সদাগর। আশ্চর্য।
ছক্কা। শুভ গোধূলিলগ্নে পিতামহ চার মুখে একসঙ্গে তুললেন চার হাই।
সদাগর। বাস্ রে। ফল হল কী।
ছক্কা। বেরিয়ে পড়ল ফস্ ফস্ ক'রে ইস্কাবন, রুইতন, হরতন, চিঁড়েতন। এঁরা সকলেই প্রণম্য। (প্রণাম)
রাজপুত্র। সকলেই কুলীন?
ছক্কা। কুলীন বৈকি। মুখ্য কুলীন। মুখ থেকে উৎপত্তি।” — তাসের দেশ, দ্বিতীয় দৃশ্য
- “পঞ্জা। ওহে বিদেশী, শাস্ত্রমতে তোমাদেরও তো একটা উৎপত্তি ঘটেছিল?
সদাগর। নিশ্চিত। পিতামহ ব্রহ্মা সৃষ্টির গোড়াতেই সূর্যকে সেই শানে চড়িয়েছেন অমনি তাঁর নাকের মধ্যে ঢুকে পড়ল একটা আগুনের স্ফুলিঙ্গ। তিনি কামানের মতো আওয়াজ ক'রে হেঁচে ফেললেন--সেই বিশ্ব-কাঁপানি হাঁচি থেকেই আমাদের উৎপত্তি। ” — তাসের দেশ, দ্বিতীয় দৃশ্য
- “হরতনী। চলো চলো, বীর, মরণ পণ করে বেরিয়ে পড়ি দুজনে মিলে। দেখতে পাচ্ছি যে, সামনে কী যেন কালো পাথরের ভ্রূকুটি, ভেঙে চুরমার করতে হবে। ভেঙে মাথায় যদি পড়ে পড়ুক। পথ কাটতে হবে পাহাড়ের বুক ফাটিয়ে দিয়ে। কী করতে এসেছি এখানে। ছি ছি, কেন আছি এখানে। একি অর্থহীন দিন, কী প্রাণহীন রাত্রি। কী ব্যর্থতার আবর্তন মুহূর্তে মুহূর্তে।
রুইতন। সাহস আছে তোমার, সুন্দরী?
হরতনী। আছে, আছে।
রুইতন। অজানাকে ভয় করবে না?
হরতনী । না, করব না।
রুইতন। পা যাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, পথ ফুরোতে চাইবে না।
হরতনী। কোন্ যুগে আমরা চলেছিলুম সেই দুর্গমে। রাত্রে ধরেছি মশাল তোমার সামনে, দিনে বয়েছি জয়ধ্বজা তোমার আগে আগে। আজ আর-একবার উঠে দাঁড়াও, ভাঙতে হবে এখানে এই অলসের বেড়া, এই নির্জীবের গণ্ডি, ঠেলে ফেলতে হবে এই-সব নিরর্থকের আবর্জনা।
রুইতন। ছিড়ে ফেলো আবরণ, টুকরো টুকরো ক'রে ছিঁড়ে ফেলো। মুক্ত হও, শুদ্ধ হও, পূর্ণ হও।” — তাসের দেশ, চতুর্থ দৃশ্য
- “হরতনী। বিধাতার ধিক্কারের মধ্যে আছি আমরা, মূঢ়তার অপমানে। চলো, বেরিয়ে পড়ি।
ছক্কা। একটু নড়লেই যে ওরা দোষ ধরে, বলে "অশুচি'।
হরতনী। দোষ হয় হোক, কিন্তু মরে থাকার মতো অশুচিতা নেই।” — তাসের দেশ, চতুর্থ দৃশ্য
- “রাজা। রানীবিবি, সন্দেহ হচ্ছে, তোমার মন বিচলিত হয়েছে।
রানী। সন্দেহ নেই, বিচলিত হয়েছে।
রাজা। জান? চাঞ্চল্য তাসের দেশে সব চেয়ে বড়ো অপরাধ।
রানী। জানি, আর এও জানি, এই অপরাধটাই সব চেয়ে বড়ো সম্ভোগের জিনিস।
রাজা। শাস্তির জিনিসকে তুমি বললে ভোগের জিনিস, তাসের দেশের ভাষাও ভুলে গেছ?
রানী। আমাদের তাসের দেশের ভাষায় শিকলকে বলে অলংকার, এ ভাষা ভোলবার সময় এসেছে।” — তাসের দেশ, চতুর্থ দৃশ্য
চরিত্রসমূহ
সম্পাদনা- রাজা
- রানী
- রাজপুত্র
- সদাগর
- পত্রলেখা
- মা
- ছক্কা
- পঞ্জা
- তাসের দল
- গোলাম
- টেক্কাকুমারীরা
- টেক্কানী
- ইস্কাবনী
- চিঁড়েতনী
- হরতনী
- রুইতন
- বিবিরা
- দহলা
- দহলানী