নটীর পূজা
নটীর পূজা হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক বাংলা ভাষায় রচিত একটি নাটক। এটি ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয়। এই নাটকেই প্রথম অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে নাচ ও গানের প্রয়োগ ঘটান রবীন্দ্রনাথ। এই ধারাটিই তাঁর জীবনের শেষ পর্বে “নৃত্যনাট্য” নামে পূর্ণ বিকাশ লাভ করে।
উক্তি
সম্পাদনা- “মল্লিকা। মহারানী, যাদের অনেক আছে তাদেরই অনেক আশঙ্কা। উনি রাজ্যেশ্বর, তাই ভয়ে ভয়ে সকল শক্তির সঙ্গেই সন্ধির চেষ্টা। বুদ্ধশিষ্যের সমাদর যখন বেশি হয়ে যায় অমনি উনি দেবদত্ত-শিষ্যদের ডেকে এনে তাদের আরও বেশি সমাদর করেন। ভাগ্যকে দুই দিক থেকেই নিরাপদ করতে চান।
লোকেশ্বরী। আমার ভাগ্য একেবারে নিরাপদ। আমার কিছুই নেই, তাই মিথ্যাকে সহায় করবার দুর্বলবুদ্ধি ঘুচে গেছে।” — নটীর পূজা, প্রথম অঙ্ক।
- “মালতী। তিনি ধনী, আমার দরিদ্র। দূর থেকে চূপ করে তাঁকে দেখেছি। একদিন নিজে এসে বললেন "মালতীকে আমার ভালো লাগে।" বাবা বললেন, "মালতীর সৌভাগ্য।" সব আয়োজন সারা হল যেদিন এলেন তিনি দ্বারে। বরের বেশে নয় ভিক্ষুর বেশে। কাষায়বস্ত্র, হাতে দণ্ড। বললেন, "যদি দেখা হয় তো মুক্তির পথে, এখানে নয়।"--দিদি, মনে ক'রো না--এখনো চোখে জল আসছে, মন যে ছোটো।
শ্রীমতী। চোখের জল বয়ে যাক না। মুক্তিপথের ধুলো ওই জলে মরবে।
মালতী। প্রণাম করে বললেম, "আমার তো বন্ধন ক্ষয় হয়নি। যে আংটি পরাবে কথা দিয়েছিলে সেটি দিয়ে যাও।" এই সেই আংটি। ভগবানের আরতিতে এটি যেদিন আমার হাত থেকে তাঁর পায়ে খসে পড়বে সেইদিন মুক্তির পথে দেখা হবে।
শ্রীমতী। কত মেয়ে ঘর বেঁধেছিল, আজ তারা ঘর ভাঙল। কত মেয়ে চীবর পরে পথে বেরিয়েছে, কে জানে সে কি পথের টানে, না পথিকের টানে? কতবার হাত জোড় করে মনে মনে প্রার্থনা করি--বলি, "মহাপুরুষ, উদাসীন থেকো না। আজ ঘরে ঘরে নারীর চোখের জলে তুমিই বন্যা বইয়ে দিলে, তুমিই তাদের শান্তি দাও।" রাজবাড়ির মেয়েরা ওই আসছেন।” — নটীর পূজা, প্রথম অঙ্ক।
- “বাসবী। একটু ঝগড়া কর না কেন, শ্রীমতী? এত মধুর কি সহ্য হয়? মানুষকে লজ্জা দেওয়ার চেয়ে মানুষকে রাগিয়ে দেওয়া যে ঢের ভালো।
শ্রীমতী। ভিতরে তেমন ভালো যদি হতেম বাইরে মন্দর ভান করলে সেটা গায়ে লাগত না। কলঙ্কের ভান করা চাঁদকেই শোভা পায়। কিন্তু অমাবস্যা! সে যদি মেঘের মুখোশ পরে?” — নটীর পূজা, প্রথম অঙ্ক।
- “লোকেশ্বরী। পুত্র যখন অপুত্র হয়ে মার কাছে আসে তার মতো দুঃখ আর নেই। কী রকম করে সে চাইলে আমার দিকে। তার মা একেবারে লুপ্ত হয়ে গেছে-- কোথাও কোনো তার চিহ্নও নেই। নিজের এতবড়ো নিঃশেষে সর্বনাশ কল্পনাও করতে পারতুম না।
মল্লিকা। রক্তমাংসের জন্মকে সম্পূর্ণ ঘুচিয়ে ফেলে এঁরা যে নির্মল নূতন জন্ম লাভ করেন।
লোকেশ্বরী। হায় রে রক্তমাংস। হায় রে অসহ্য ক্ষুধা, অসহ্য বেদনা। রক্তমাংসের তপস্যা এদের এই শূন্যের তপস্যার চেয়ে কি কিছুমাত্র কম!
মল্লিকা। কিন্তু যাই বল দেবী, তাঁকে দেখলেম, সে কী রূপ। আলো দিয়ে ধোওয়া যেন দেবমূর্তিখানি।
লোকেশ্বরী। ওই রূপ নিয়ে তার মাকে সে লজ্জা দিয়ে গেল। যে মায়ের প্রাণ আমার নাড়ীতে, যে মায়ের স্নেহ আমার হৃদয়ে, তাকে ওই রূপ ধিক্কার দিলে। যে-জন্ম তাকে দিয়েছি আমি, সে-জন্মের সঙ্গে তার এ-জন্মের কেবল যে বিচ্ছেদ তা নয়, বিরোধ। দেখ্ মল্লিকা আজ খুব স্পষ্ট করে বুঝতে পারলেম এ ধর্ম পুরুষের তৈরি। এ ধর্মে মা ছেলের পক্ষে অনাবশ্যক; স্ত্রীকে স্বামীর প্রয়োজন নেই। যারা না পুত্র না স্বামী না ভাই সেই সব ঘরছাড়াদের একটুখানি ভিক্ষা দেবার জন্যে সমস্ত প্রাণকে শুকিয়ে ফেলে আমরা শুন্য ঘরে পড়ে থাকব! মল্লিকা, এই পুরুষের ধর্ম আমাদের মেরেছে, আমরাও একে মারব।” — নটীর পূজা, দ্বিতীয় অঙ্ক।
- “মালতী। দিদি, বাইরে ওই যেন মরণের কান্না শুনতে পাচ্ছি। আকাশে দেখছ ওই শিখা! নগরে আগুন লাগল বুঝি। জন্মোৎসবে এই মৃত্যুর তাণ্ডব কেন।
শ্রীমতী। মৃত্যুর সিংহদ্বার দিয়েই জন্মের জয়যাত্রা।
মালতী। মনে ভয় আসছে বলে বড়ো লজ্জা পাচ্ছি দিদি। পূজা করতে যাব, ভয় নিয়ে যাব--এ আমার সহ্য হচ্ছে না।
শ্রীমতী। তোর ভয় কিসের বোন।
মালতী। বিপদের ভয় না। কিছুই যে বুঝতে পারছিনে, অন্ধকার ঠেকছে, তাই ভয়।
শ্রীমতী। আপনাকে এই বাইরে দেখিসনে। আজ যাঁর অক্ষয় জন্ম তাঁর মধ্যে আপনাকে দেখ্, তোর ভয় ঘুচে যাবে।” — নটীর পূজা, দ্বিতীয় অঙ্ক।
- “মালতী। শোনো দিদি, আবার গর্জন। দয়া নেই, কারো দয়া নেই। অনন্তকারুণিক বুদ্ধ তো এই পৃথিবীতেই পা দিয়েছেন তবু এখানে নরকের শিখা নিবল না। আর দেরি করতে পারিনে। প্রণাম, দিদি। মুক্তি যখন পাবে আমাকে একবার ডাক দিয়ো, একবার শেষ চেষ্টা করে দেখো।” — নটীর পূজা, তৃতীয় অঙ্ক।
- “মল্লিকা। চুপ চুপ, আস্তে। জান তো, অভিশাপের ভয়ে উনি কী রকম অবসন্ন হয়ে পড়েছেন।
রত্নাবলী। কার অভিশাপ?
মল্লিকা। বুদ্ধের। মনে মনে মহারাজ ওঁকে ভারি ভয় করেন।
রত্নাবলী। বুদ্ধ তো কাউকে অভিশাপ দেন না। অভিশাপ দিতে জানে দেবদত্ত।
মল্লিকা। তাই তার এত মান। দয়ালু দেবতাকে মানুষ মুখের কথায় ফাঁকি দেয়, হিংসালু দেবতাকে দেয় দামি অর্ঘ্য।
রত্নাবলী। যে-দেবতা হিংসা করতে জানে না, তাকে উপবাসী থাকতে হয়, নখদন্তহীন বৃদ্ধ সিংহের মতো।” — নটীর পূজা, তৃতীয় অঙ্ক।
- “রত্নাবলী। ভয় করতে লজ্জা করছে না?
বাসবী। একটুমাত্রও না। শ্রীমতী, সেই ক্ষমার মন্ত্রটা।
শ্রীমতী। উত্তমঙ্গেন বন্দেহং পাদপংসু-বরুত্তমং বুদ্ধে যো খলিতো দোসো বুদ্ধো খমতু তং মম।
বাসবী। বুদ্ধো খমতু তং মম, বুদ্ধো খমতু তং মম, বুদ্ধো খমতু তং মম।” — নটীর পূজা, চতুর্থ অঙ্ক।
- “রত্নাবলী। (শ্রীমতীর পাদস্পর্শ করিয়া প্রণাম। জানু পাতিয়া বসিয়া)
বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি
ধম্মং সরণং গচ্ছামি
সংঘং সরণং গচ্ছামি।” — নটীর পূজা, চতুর্থ অঙ্ক।
চরিত্রসমূহ
সম্পাদনা- লোকেশ্বরী - রাজমহিষী, মহারাজ বিম্বিসারের পত্নী
- মল্লিকা - মহারানী লোকেশ্বরীর সহচরী
- বাসবী নন্দা রত্নাবলী অজিতা ভদ্রা - রাজকুমারীগণ
- উৎপলপর্ণা - বৌদ্ধ ভিক্ষুণী
- শ্রীমতী - বৌদ্ধধর্মরতা নটী
- মালতী - বৌদ্ধধর্মানুরাগিণী পল্লীবালা, শ্রীমতীর সহচরী
- রাজকিংকরী ও রক্ষিণীগণ