বাসন্তিকা
বাসন্তিকা কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একাঙ্ক নাটক। নাটকটি বাসন্তিকা নামে প্রথম গ্রন্থভুক্ত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে আব্দুল আজিজ সম্পাদিত 'অপ্রকাশিত নজরুল' নামে। পরে তা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আকাদেমির 'কাজী নজরুল ইসলাম রচনা সমগ্র'তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
সংলাপ
সম্পাদনা(গান)
এল ওই বনান্তে পাগল বসন্ত।
বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে
চঞ্চল তরুণ দুরন্ত॥
বাঁশিতে বাজায় সে বিধুর
পরজ-বসন্তের সুর
পাণ্ডু কপোলে জাগে রং নব অনুরাগে,
রাঙা হল ধূসর দিগন্ত॥
কিশলয়-পর্ণে অশান্ত
ওড়ে তার অঞ্চলপ্রান্ত,
পলাশকলিতে তার ফুলধনু লঘুভার
ফুলে ফুলে হাসি অফুরন্ত॥
এলোমেলো দখিনা মলয় রে
প্রলাপ বকিছে বনময় রে,
অকারণ মনোমাঝে বিরহের বেণু বাজে
জেগে ওঠে বেদনা ঘুমন্ত॥
চৈতালি :
ভয় কী সম্রাজ্ঞী! তব কণ্ঠের বিভব
সীমাহীন মহীয়ান বৈচিত্রে সুরের!
বহুরূপী কণ্ঠে তব বহু সুরে গান
শুনিয়াছি বহুবার, মেনেছি বিস্ময়।
গাহো গান আনন্দের। যদি সে পথিক
সত্যই আসিয়া যায়, সে যেন জানিতে
না পারে তোমার সখী মরমের কথা।
সে যেন আসিয়া হেরে, তুমি মূর্তিমতী
আনন্দ-প্রতিমা, তুমি সম্রাজ্ঞী বনের।
রাজাই সে হয় যদি, এসে দেখে যাক
রানির মহিমা তব, শির নত করি
উদ্দেশে সে নিবেদন করুক প্রণাম।
............
চৈতালি :
তা হলে আমিও গাই উৎসাহের গান।
জ্বালাইলে কবে রানি! হায়, পরিচয়
না হতেই মনে মনে মান অভিমান
পরিচয় ঘন হলে আরও কত হবে!
প্রেমিকা তো নহি, তাই কিছু নাহি বুঝি।
বাসন্তিকা :
আঁখি-বিনিময়ে আঁখি চিনি লয় যারে
পলকে যে জিনি লয় সকল হৃদয়
সে বহু জনমের সাথি, বন্ধু, সখা।
চৈতালি! রহস্য এর তুই বুঝিবি না।
জন্মে জন্মে নব নব রূপে তার সাথে
বিরহ-মিলন, হয় নব জানাজানি।
ব্যথা দিয়ে চলে যায় জন্মান্তর পারে,
একজন চলে যায় – সাথি তার খোঁজে
আসে নব রূপ ধরি তারই পিছু পিছু।
আত্মার আত্মীয় যার সাথি প্রিয়তম
শুধু সেই জানে সখী রহস্য ইহার।
হৃদয় বরিয়া লয় হৃদি-দেবতারে।
(দূরে কোকিলের অবিরল কুহুধ্বনি)
চৈতালি :
ওই বুঝি এল তব হৃদিরাজদূত
মুহুর্মুহু কুহুস্বরে কাঁপায়ে কান্তার।
মর্মরিয়া লতাপাতা দখিনা পবন
সহসা আসিল ওই, উতলা কানন।
সহচর অনুচর দূত এল যবে
রাজাও আসিছে পিছে মনে লাগে মোর।
উষসীর আগমনে বুঝি লো যেমন
তপনের উদয়ের আর নাহি দেরি।
বাসন্তিকা :
চৈতালি! কী হবে তবে? সত্যই সে যদি
এসে পড়ে, হেরে মোরে বিরহ-বিধুরা
কী হবে, এ মুখ সখী কেমনে লুকাই,
তুই বলে দে লো সখী, কী করিব আমি!
প্রণয় মধুর – যত রহে সে গোপন,
প্রকাশের লজ্জা তার অতি নিদারুণ।
লজ্জায় মরিয়া যাব, সে যদি লো বোঝে
ইঙ্গিতেও মোর পোড়া মরমের ব্যথা!
............
ফাল্গুনী :
ছল করি উহাদেরে লয়ে গেল দূরে
চৈতালি তোমায় সখী। কেন নত চোখে
চেয়ে আছ? কথা কও চাহো মুখপানে।
(বাসন্তিকার গান)
অঞ্জলি লহো মোর সংগীতে
প্রদীপ-শিখাসম কাঁপিছে প্রাণ মম
তোমায়, হে সুন্দর বন্দিতে।
সংগীতে সংগীতে॥
তোমার দেবালয়ে কী সুখে কী জানি
দুলে দুলে ওঠে আমার দেহখানি
আরতি নৃত্যের ভঙ্গিতে।
সংগীতে সংগীতে॥
পুলকে বিকশিল প্রেমের শতদল
গন্ধে রূপে রসে টলিছে টলমল।
তোমার মুখে চাহি আমার বাণী যত
লুটাইয়া পড়ে ঝরা ফুলের মতো
তোমার পদতল রঞ্জিতে।
সংগীতে সংগীতে॥
............
বাসন্তিকা :
বসন্তের রাজা মোর! হৃদয়ের নাথ!
একী তব অরুন্তুদ অকরুণ গান?
অকারণ কেন মোরে দেখাও এ ভয়?
তুমি কি জান না নাথ, তুমি চলে গেলে
ফুরাইবে রাজ্যে মোর বসন্ত-উৎসব?
ফাল্গুনী :
আমি চিরচঞ্চল পথিক ঘরছাড়া,
বন্ধুহারা, উদাসীন, বিরাগী প্রেমিক।
সাথি মম পঞ্চশর দক্ষিণ সমীর,
ক্ষণিকের পথভোলা পথিক এরাও।
দুদিনের পিককুল মোর অগ্রদূত।
প্রজাপতি অলি – এরা মোর বৈতালিক।
ক্ষণিকের অতিথি যে আমরা সকলে,
কেন ভুলিতেছ প্রিয়া? নাই সাধ্য নাই,
এর বেশি পৃথিবীতে থাকিবার আর।
বসন্ত হয় অবসান, দিগন্তে বিদায়ের বেণু
ওই শোনো বাজি ওঠে সকরুণ রবে।
আমারে যে যেতে হবে। জনমে জনমে
এমনই আসিব কাছে দু-দিনের লাগি,
না মিটিতে সাধ শেষে চলে যেতে হবে!
বিধির বিধান ইহা, যথা ভলোবাসা!
মিলন ক্ষণিক সেথা, অনন্ত বিরহ।
বাসন্তিকা :
যেতে নাহি দিব আমি। তুমি রাজা, বীর,
আমারে বধিয়া যাও তব রাজ্যে ফিরে।
না, না, তব পায়ে পড়ি, থাকো ক্ষণকাল
পরুষ বচন আর কভু শোনাব না।
............
বাসন্তিকা :
কোথা তুমি প্রিয়তম ফাল্গুনী কিশোর?
নিশীথের ক্ষণিকের সুখ-স্বপ্নসম
আসিয়া গেলে কি চলি না মিটিতে সাধ?
দূরে ওই ওড়ে যেন বৈশাখী ঝড়ের
বিজয়-কেতন তার। বাসন্তী উৎসব
শেষ হোক আজি তবে। ঝরা ফুলদল,
বিরহের রৌদ্রদাহে মোর বনভূমি
পুড়ে যাক, উড়ে যাক, হোক ছারখার।
যোগিনীর গৈরিক নিশান নীলাম্বরে
এবার উড়ুক তবে। বিস্মৃতির ধূলি
ছেয়ে দিক রাজ্য মোর শস্য পুষ্পময়॥
(গান)
ভোরে স্বপনে কে তুমি দিয়ে দেখা
লুকালে সহসা।
মোর তপনের রাঙা কিরণ যেন
ঘিরিল তমসা॥
না ফুটিতে মোর কথার কুঁড়ি
চপল বুলবুলি গেলে উড়ি
গেলে ভাসিয়া ভোরের সুর যেন
বিষাদ-অলসা॥
জেগে দেখি হায় ঝরা ফুলে আছে ছেয়ে
তোমার পথতল
ওগো অতিথি, কাঁদিছে বনভূমি
ছড়ায়ে ফুলদল।
মুখর আমার গানের পাখি
নীরব হল হায় বারেক ডাকি
যেন ফাগুনের জোছনা-হসিত রাতে
নামিল বরষা॥
কুশীলব
সম্পাদনা(পুরুষ)
ফাল্গুনী হৃদয়-রাজ্যের রাজা
দখিন হাওয়া ওই মন্ত্রী
কোকিল ওই দূত
পঞ্চশর ওই সেনাপতি
ভ্রমর, মৌমাছি, প্রজাপতি দোয়েল শ্যামা… বৈতালিক দল।
(নারী)
বাসন্তিকা ফুলের দেশের রানি
চৈতালি রানির প্রিয় সহচরী