বিদ্যাপতি (পালা – নাটিকা)

বিদ্যাপতি কাজী নজরুল ইসলাম-এর একটি পালা নাটিকা।


(স্তব)
জয় জগজ্জননী, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর-বন্দিতা,
জয় মা ত্রিলোকতারিণী।
জয় আদ্যাশক্তি পরমেশ্বরী নন্দনলোক-নন্দিতা
জয় দুর্গতিহারিণী॥
তোমাতে সর্বজীবের বসতি, সর্বাশ্রয় তুমি মা,
ক্ষয় হয় সব বন্ধন পাপতাপ তব পদ চুমি মা।
তুমি শাশ্বতী, সৃষ্টি-স্থিতি, তুমি মা প্রলয়কারিণী॥
তুমি মা শ্রদ্ধা প্রেমভক্তি তুমি কল্যাণ-সিদ্ধি,
ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ তুমি তন-জন-ঋদ্ধি।
জয় বরাভয়া ত্রিগুণময়ী দশপ্রহরণধারিণী
জয় মা ত্রিলোকতারিণী॥

অনুরাধা : ঠাকুর! ঠাকুর!
বিদ্যাপতি : (মন্দির-অভ্যন্তর হইতে) কে?
অনুরাধা : আমি অনুরাধা, একটু বাইরে বেরিয়ে আসবে?
বিদ্যাপতি : (মন্দিরদ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিয়া – বিরক্তির সুরে) একটু অপেক্ষা করলেই পারতে অনুরাধা। এত বড়ো ভক্তিমতী হয়ে তুমি মায়ের নামগানে বাধা দিলে?
অনুরাধা : আমায় ক্ষমা করো ঠাকুর। অত্যন্ত প্রয়োজনে আমি তোমার ধ্যানভঙ্গ করেছি। আমার কৃষ্ণগোপালের জন্য আজ কোথাও ফুল পেলাম না। তোমার বাগানে অনেক ফুল, আমার গিরিধারীলালের জন্য কিছু ফুল নেব? আমার গোপালের এখনও পূজা হয়নি।
বিদ্যাপতি : তুমি তো জান অনুরাধা, এ বাগানে ফুল ফোটে শুধু আমার মায়ের পায়ে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য। এ ফুল তো অন্য কোনো দেবদেবীকে দিতে পারিনে! (মন্দিরদ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন; মন্দির-অভ্যন্তরে স্তব-পাঠের মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল।)
অনুরাধা : (অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে) ঠাকুর! ঠাকুর! তুমি কি সত্যই এত নিষ্ঠুর? তবে কি আমার ঠাকুরের পূজা হবে না আজ? আমার কৃষ্ণগোপাল! আমার প্রিয়তম! তুমি যদি সত্য হও আর আমার প্রেম যদি সত্য হয়, তা হলে আজ এই বাগানের একটি ফুলও অন্য কারুর পূজায় লাগবে না। এই বাগানের সকল ফুল তোমার চরণে নিবেদন করে গেলাম।
(প্রস্থান)
বিদ্যাপতি : (গুনগুন স্বরে)
মা! আমার মনে আমার বনে
ফোটে যত কুসমদল
সে ফুল মাগো তোরই তরে
পূজতে তোরই চরণতল॥

............


[গান]
জনম অবধি হাম রূপ নেহারলুঁ, নয়ন ন তিরপিত ভেল।
লাখ লাখ যুগ হিয় হিয় রাখলুঁ, তবু হিয় জুড়ন ন গেল!
দেখি সাধ না ফুরায় গো!
হিয়া কেন না জুড়ায় গো
হিয়ার উপরে গিয়া
হিয়া তবু না জুড়ায় গো!

তৃতীয় খণ্ড
[অনুরাধার গীত]

সখী লো –
অব মথুরাপুর মাধব গেল।
গোকুল-মানিক কো হরি লেল॥
(হরি হরিয়া নিল কে)
গোকুলে উছলল করুণাক রোল
নয়নক সলিলে বহয়ে হিলোল।
শূন ভেল মন্দির, শূন ভেল নগরী,
শূন ভেল দশদিশি শূন ভেল সগরী।
কৈছন যাওব যমুনা-তীর
কৈছে নেহারব কুঞ্জ-কুটির।
নয়নক নিন্দ গেও, বয়ানক হাস,
সুখ গেও পিয়া সঙ্গ, দুখ হম পাশ।
পাপ পরান মম আন নাহি জানত
কানু কানু করি ঝুরে।
বিদ্যাপতি কহ নিকরুণ মাধব
রাধারে কাঁদায়ে রহি দূরে॥

.................


(গান গাহিতে গাহিতে অনুরাধার প্রবেশ)
সজল নয়ন করি পিয়া পথ হেরি হেরি
তিল এক হয় যুগ চারি।
(যেন শত যুগ মনে হয়
তারে এক তিল না হেরিলে শত যুগ মনে হয়)
বিধি বড়ো দারুণ তাহে পুন ঐছন
দরহি করলুঁ মুরারি।
আন অনুরাগে পিয়া আনদেশে গেলা
পিয়া বিনু পাঁজর ঝাঁঝর ভেলা।
নারীর দীরঘশ্বাস পড়ুক তাহার পাশ
মোর পিয়া পাশে উড়ি যাওঁ
সব দুখ কহু তার পাশে।
আনি দেহ মোর পিউ রাখহ আমার জিউ
কো আছ করুণাবান।

বিদ্যাপতি : বিদ্যাপতি কহে ধৈরজ করো চিত

তুরিতহি মিলব কান॥
রানি : অনুরাধা, কী মিষ্টি নাম তোমার! তুমি আমার কাছে থাকবে? বিদ্যাপতি! তুমি যদি অনুমতি দাও, অনুরাধাকে আমার কাছে রেখে শ্যাম নাম শুনি।
বিদ্যাপতি : আমি তো ওর অভিভাবক নই; দেবী! ও আমার ছোটো বোন বিজয়ার বন্ধু।
রানি : ওর বাবা-মা কোথায় থাকেন?
বিদ্যাপতি : গতবার দেশে যখন মড়ক লাগে, তখন ওর বাবা-মা দুজনেই মারা যান। যে বিসকি গ্রাম মহারাজ আমায় দান করেছেন, ওর বাবা ছিলেন সেই গ্রামের বিষ্ণু-মন্দিরের পুরোহিত। এখন ওর অভিভাবিকা, বন্ধু – সব বিজয়া।


............


অনুরাধা : অত শত ঘোর-প্যাঁচের কথা বুঝিনে, ঠাকুর! আমি ভালোবেসে কাঁদতে চাই, তাই কাঁদি। বুকে পেলে কান্না যাবে ফুরিয়ে, প্রেম যাবে শুকিয়ে – তাই পেতে চাইনে। বুকের ধনকে বিলিয়ে দিই অন্যকে। আমি চললাম ঠাকুর, আমি চললাম। আমি কাল সকালে তোমার কবিতালক্ষ্মীকে দেখাব!

[অনুরাধার গান]
হাম অভাগিনি, দোসর নাহি ভেলা।
কানু কানু করি যাম বহি গেলা।
মনে মোর যত দুখ কহিব কাহাকে।
ত্রিভুবনে যত দুখ নাহি জানে লোকে।
জনম অবধি মোর এই পরিণাম
আমিই চাহিব শুধু, চাহিবে না শ্যাম!

বিদ্যাপতি : ভণয়ে বিদ্যাপতি, শুন ধনি রাই

কানু সমঝাইতে হাম চলি যাই॥

............


[বিদ্যাপতির গান]

মাধব,
বহুত মিনতি করি তোয়।
দেই তুলসীতিল দেহ সমর্পলুঁ-
দয়া জনু ছোড়বি মোয়॥
গণইতে দোষ গুণ-লেশ না পাওবি
যব তুঁহু করবি বিচার,
তুঁহু জগন্নাথ জগতে কহায়সি
জগ-বাহির নহি মুই ছার॥
কিয়ে মানুষ পশু পাখি কিয়ে জনমিয়ে
অথবা কীটপতঙ্গ
করম-বিপাকে গতায়তি পুন পুন
মতি রহু তুয়া-পরসঙ্গ।
ভণয়ে বিদ্যাপতি অতিশয় কাতর
তরইতে ইহ ভবসিন্ধু –
তুয়া পদ-পল্লব করি অবলম্বন
তিল এক দেহ দীনবন্ধু॥

রাজা : আহা, আবার বলো সখা – আবার বলো :

মাধব! তরইতে ইহ ভবসিন্ধু –
তুয়া পদপল্লব করি অবলম্বন
তিল-এক দেহ দীনবন্ধু!

আঃ আমার মাথা কার কোলে?
রানি : রাজা! আমি দাসী – লছমী।
রাজা : লছমী! ওঃ! কে কাঁদে আমার পায়ে পড়ে?
অনুরাধা : রাজা! আমি, আমি – অনুরাধা। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বিষ্ণু-উপাসক, পরম প্রেমিক – তুমি, আমায় পায়ের ধুলো দিয়ে যাও, আমি ওই চরণধূলির প্রসাদে – মুক্ত হয়ে যাই!
রাজা : অনুরাধা! আমি যে কৃষ্ণকে পেয়েছি ধ্যানে, সে কৃষ্ণকে তুমি যে রেখেছ বুকে পুরে। অনুরাধা – অনুরাধা – কী মধুর নাম! এই তো আমার বৃন্দাবন। বিদ্যাপতি, নারায়ণ, লছমী, অনুরাধা – কৃষ্ণনাম গান – এরই মাঝে যেন জন্মে জন্মে আসি – শ্রীকৃষ্ণ মাধব মা-ধ-ব…(রাজার মৃত্যু) বিদ্যাপতি, অনুরাধা, লছমী :
............


বিদ্যাপতি : রানি! তুমি কি সেই লছমী, না তার কঙ্কাল, প্রেত? সত্যই তুমি আজ একা – তোমার প্রেম তোমায় ছেড়ে গেছে!
রানি : বিদ্যাপতি! প্রিয়তম! সত্যই আজ আমি নিঃসম্বল, তুমি ছাড়া ত্রিজগতে আজ আর আমার কেউ নেই। তুমি আমায় তাড়িয়ে দিয়ো না!
বিদ্যাপতি : রানির মহিমা প্রেমের মহিমাকে তুমি এমন করে পদদলিত করবে লছমী, এ আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল। শোনো রানি – আমি চেয়েছিলাম তোমাকেই – রাজা যদি জীবিত থাকতেন হয়তো তোমাকেই, শুধু তোমাকেই চাইতাম। কিন্তু আজ আর তোমাকে চাই না। রাজার মৃত্যু তাঁর অচিন্তনীয় ত্যাগ আমাকে সত্যকার প্রেমের পথ দেখিয়ে দিয়েছে। পাথর কুড়াতে গিয়ে আমি পেয়েছি পরশ-মানিক। তাঁর ছোঁয়ায় আমার সকল কাম হয়ে গেছে সোনা। তোমার মধ্য দিয়ে আমি পেয়েছি সত্য-কার লছমী দেবীকে – নারায়ণীকে, নারায়ণকে।
রানি : নিষ্ঠুর! তুমি আমায় প্রত্যাখ্যান করছ? তুমি তা হলে এতদিন গানে গানে সুরে সুরে আমায় প্রতারণা করেছ? নির্মম ব্যাধের জাত তোমরা, বাঁশির সুরে ডেকে হরিণীকে বধ করাই তোমাদের ধর্ম।
বিদ্যাপতি : দেবী! আমি তোমায় প্রতারণা করিনি। প্রত্যাখ্যানও করছিনে। তুমি যা চাও আমার সে প্রেম তো তুমি পেয়েছ।
রানি : না, পাইনি; পেলে আমার অন্তরে এ হাহাকার থাকত না। শোনো বিদ্যাপতি, আমি চাই না শূন্য প্রেম – যাকে ধরা-ছোঁয়া যায় না, আমি চাই তোমাকে – তোমার প্রাণ-মন-দেহ-আত্মা – তোমার সকল কিছুকে।
বিদ্যাপতি : আমি তো বলেছি, আমার কামনা একদিন ছিল – আজ আর নেই। এই কামনাশূন্য-দেহ নিয়ে শবসাধনা করে তোমারও মুক্তি হবে না, আমারও হবে অধোগতি। তোমার এই প্রেম শ্রীকৃষ্ণে – অর্পণ করো, তুমি সুখী হবে, শান্তি পাবে। আর তা না পারলেও তোমার প্রেম যদি সত্য হয়, আমাকে ভালোবেসে তুমি শ্রীভগবানের করুণা লাভ করবে।
রানি : আমি চাই না, চাই না অন্যকিছু, চাই না মুক্তি। আমি চাই তোমাকে – স্বর্গে হোক, নরকে হোক, যেখানে হোক আমি চাই কেবল তোমাকে বিদ্যাপতি, তোমাকে। আমি তোমাকে পেতে চাই আমার বক্ষে, আমার চক্ষে, আমার প্রতি অঙ্গ দিয়ে তোমার প্রতি অঙ্গের পরশ পেতে!
বিদ্যাপতি : লছমী! লছমী! ছাড়ো! ছাড়ো! যেতে দাও, পালিয়ে যেতে দাও আমাকে এখান থেকে।… তুমি প্রেম-অপভ্রষ্টা মায়াবিনী রূপ ধরে আমায় শ্রীভগবানের পথ থেকে ফিরাতে এসেছ। এ কী জ্বালাময় তোমার স্পর্শ! উঃ – আমি পালিয়ে গিয়ে এই তপস্যাই করব লছমী; যেন তোমাকে এই নীচে থেকে ঊর্ধ্বে টেনে তুলতে পারি। (ছুটিয়া চলিলেন)
লছমী : বিদ্যাপতি! বিদ্যাপতি! নিষ্ঠুর!

চরিত্র

সম্পাদনা


দেবী দুর্গা,
দেবী গঙ্গা,
কবি বিদ্যাপতি,
শিবসিংহ (মিথিলার রাজা),
লছমী (মিথিলার রানি),
অনুরাধা (বিষ্ণু-উপাসিকা),
বিজয়া (বিদ্যাপতির কনিষ্ঠা ভগ্নী),
ধনঞ্জয় (রাজ-বয়স্য)।