বিষ্ণুপ্রিয়া
বিষ্ণুপ্রিয়া কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি বিখ্যাত নাটক।
সংলাপ
সম্পাদনাঅমিতা :
তুই এমন এলিয়ে পড়েছিস কেন লা বিষ্ণুপ্রিয়া? ক্লান্ত যদি হয়ে থাকিস বরের গায়ে হেলান দিয়ে বস না!
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(চুপিচুপি) ভাই অমিতা! আমার কিছু ভালো লাগছে না। বাসর-ঘরে আসবার সময় কেমন যেন অজ্ঞানের মতো এলিয়ে পড়েছিলাম।
অমিতা :
তা তো পড়বিই। এত সুন্দর বর পেলে সবাই মুর্ছে যায়।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাঃ! শুনবে যে! না ভাই শোন–সেই সময় হোঁচট খেয়ে আমার আঙুল দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে।
অমিতা :
মাগো! কীহবে! এ কী অলুক্ষণে কথা গো!
দু-একজন মহিলা :
কী রে, কী হল অমিতা! কী বলছিস তোরা।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
চুপ! চুপ! বলিসনে কাউকে।
অমিতা :
কিচ্ছু না। এমনি। তোমরা চোরের শাস্তি দিচ্ছ দাও না। হ্যাঁ তারপর? কী করলি তুই?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
আমি বোধ হয় উহ্ করে উঠেছিলাম। অমনি উনি ওঁর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে আমার পায়ে আঙুল চেপে ধরলেন। অমনি রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বেদনাও আর রইল না। তবু কেন যেন আমার বুক কাঁপছে ভাই ভয়ে।
বিধুমুখী :
কী হয়েছে মা! তোমার মুখ চোখ অমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কিচ্ছু না, কাকিমা। সত্যি,কিছু হয়নি।
অমিতা :
সারাদিন উপোস করেছে, তারপর খেয়েই এই হট্টগোল। তুমি যাও কাকিমা, আমরা আছি। বেশি ক্লান্ত হলে ওকে আমরা শুইয়ে দেব।
একজন মহিলা :
ইস্! শুইয়ে দিলেই হল আর কী। আমরা বুঝি যুগল-মিলন দেখব না। ছাদনাতলায় শুভদৃষ্টির সময় যেমন হেসে দুজন চোখ চাওয়া-চাওয়ি করেছিলে, তেমনি করে আর একবার চাও, নইলে ছাড়ছিনে।
নিমাই :
তা যত ইচ্ছে চিমটি কাটুন, ও অপকর্ম এত লোকের সামনে করতে পারব না।
উক্ত মহিলা :
কী! অমন সুন্দর মুখের দিকে চাওয়া বুঝি অপকর্ম। লুকিয়ে লুকিয়ে এর মধ্যে তো একশোবার দেখে নিলে, আমাদের চোখ তোমাদের চোখের মতো ডাগর না হলেও দেখতে পাই।
নিমাই :
তাহলে আবার ধরা পড়ে গেছি। চোরের আবার শাস্তি চলুক।
জনৈক তরুণী :
এবার শাস্তি হাত দিয়ে নয়, কথা দিয়ে।
অন্য একজন তরুণী :
শুধু কথার বাণ নয় লো, তাতে সুরের বিষ মিশিয়ে।
নিমাই :
প্রমীলার দেশে যখন এসে পড়েছি তখন আর উপায় তো নেই। আঁখি বাণ সহ্য করেও যদি বেঁচে থাকতে পারি, বাক্যবাণও বোধ হয় সইবে।
জনৈক তরুণী :
তাহলে বীর প্রস্তুত হও।
(গান)
প্রেম-পাশে পড়লে ধরা চঞ্চল চিত-চোর
শাস্তি পাবে নিঠুর কালা এবার জীবন-ভোর॥
মিলন রাসের কারাগারে
প্রণয়-প্রহরী রাখব দ্বারে
চপল চরণে পরাব শিকল নব অনুরাগ-ডোর॥
শিরীষ-কামিনী ফুল হানি জরজর করিব অঙ্গ
বাঁধিব বাহুর বাঁধনে দংশিবে বেণি-ভুজঙ্গ
কলঙ্ক-তিলক আঁকিব ললাটে হে গৌর-কিশোর॥
(হুলুধ্বনি, আনন্দধ্বনি ইত্যাদি–বাহিরে বাদ্য।)
...........
বিষ্ণুপ্রিয়া :
(অশ্রু ছল ছল কণ্ঠে) তোমার পায়ে পড়ি, তুমি অমন কথা বোলো না, ও-কথা শুনলেও পাপ হয়। আমি তোমার এই পা ছুঁয়ে বলছি–তোমার মুখে শোনবার আগে ও-কথা আমার স্বপ্নেও মনে হয়নি। তুমি কেন এ কথা বললে বলো! ও-কথা মনে আসবার আগে যেন আমার মরণ হয় – মরণ হয় –
নিমাই :
ওকী! এই সামান্য কথায় এমন করে কাঁদতে আছে? তুমি এত কষ্ট পাবে জানলে আমি কখনই এ-কথা বলতাম না। আমি এমনি রহস্য করে বললাম মাত্র, আর অমনি মানিনীর মানে আঘাত লাগল। আচ্ছা,আর একটি কথার উত্তর দাও দেখি। বিয়ের আগে তুমি আমায় ভালোবেসেছিলে?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
যাও! কে তোমাকে এ কথা বললে? তুমি সকলের অন্তর্যামী কিনা।
নিমাই :
নিশ্চয়ই। আমি যখন স্বামী অর্থাৎ কিনা নারায়ণ, কাজেই অন্তর্যামীও। নইলে তোমার অন্তরের কথা কী করে জানলাম?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি কিছু জান না। জানলে বিয়ের আগে অমন করে কাঁদতে না।
নিমাই :
ও! তোমার সঙ্গে বিয়ের আগে একবার সম্বন্ধ ভাঙে ভাঙে হয়েছিল, সেই কথা বলছ বুঝি? তাতে কিন্তু আমার কোনো দোষ ছিল না। আমাকে না জানিয়েই মা কাশী মিশ্রকে পাঠিয়ে ছিলেন সম্বন্ধ ঠিক করতে। তাই তোমাদের গণক ঠাকুরকে বলেছিলাম, আমি বিয়ের কিছু জানিনে। কিন্তু তারপর আমি তো আবার লুকিয়ে লোক পাঠিয়েছিলাম বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
সে তোমার দয়া। সবাই বলে, তুমি করুণাময়। নইলে আমার কী দশা হত তাই ভাবি।
নিমাই :
তাহলে তোমারও দশা পাবার অবস্থা হয়েছিল বলো। তাই তো বলি, রোজ রোজ গঙ্গার ঘাটে আমার মাকে তোমার এত ঘটা করে প্রণাম করার মানে কী। আর দিনে দশবার করে গঙ্গার ঘাটে আসারই বা হেতু কী?
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুমি পণ্ডিত মানুষ, ন্যায়শাস্ত্রবিদ, তাই ধোঁয়া দেখলেই সেখানে আগুনের সন্দেহ কর। আমার বয়ে গেছিল তোমাকে দেখতে যাবার জন্য। আমি যেতুম মাকে দেখতে।
নিমাই :
কিন্তু মা তো থাকতেন তোমার ঘাটেই, তুমি হাঁ করে আমি যে ঘাটে সাঁতার কাটতাম সেদিকে চেয়ে থাকতে কেন?
[দূরে কাঞ্চনার গান]
সিনান করিতে গিয়েছিনু সই সেদিন গঙ্গাতটে।
উদয় হলেন গৌরচন্দ্র অমনি হৃদয় পটে॥
নির্মল মোর মনের আকাশে
উঠিয়া সে চাঁদ মৃদু হাসে,
তারে লুকাইতে নারি, সখী ভয়ে মরি, বুঝি কলঙ্ক রটে॥
নিমাই :
(এক লাইন গানের পর) আমি পালালুম কিন্তু। তোমার মুখরা সখীকে আমার বড়ো ভয়। ও কোন দিন আমাকে ধরিয়ে দেবে দেখছি।
[প্রস্থান]
............
বিষ্ণুপ্রিয়া :
তুই আমাকে সতিনের কথা মনে করিয়ে দিস কেন বল তো? আচ্ছা ভাই, দিদি খুব সুন্দরী ছিলেন, না? আর তোর সঙ্গে ওঁর বুঝি আমার চেয়েও বেশি ভাব ছিল?
কাঞ্চনা :
হ্যাঁ, সুন্দরী খুবই ছিলেন, তবে তোমার মতো না। ওঁর রূপে চাঁদের জ্যোতির চেয়ে সূর্যের তেজ বেশি ছিল। আর ভাব আমার এতটুকু ছিল না ওঁর সঙ্গে। যখন তখন ওঁর সঙ্গে ঝগড়া করতাম আর বলতাম – ঠাকরুন তুমি বৈকুণ্ঠের অধীশ্বরী। আমাদের ব্রজেশ্বরীর আসবার সময় হল, এবার তুমি সরে পড়ো না। এ রসের ব্রজে ব্রজেশ্বরী আর গোপিনিদের লীলা তুমি সইতে পারবে না। ঠাকরুন ভালো মানুষ, এই সব শুনে এবং বুঝে স্বর্গে চলে গেলেন।
বিষ্ণুপ্রিয়া :
কাঞ্চনা, কেন তুই ওঁর কথা এলেই ওঁকে ভগবান ভেবে কথা বলিস বল তো? তোর কথা শুনে আমার বড়ো ভয় হয়, সই। উনি যদি সত্যি সত্যিই ভগবান হয়ে যান তাহলে আমার কী অবস্থা হবে? আমি কোথায় দাঁড়াব? এক একবার আমারও মনে হয় উনি ছল করে মানুষ সেজে এসেছেন। ওঁর চোখ মুখ রূপ গুণ সব যেন বলে দেয়, আমি কারুরই নই – আমি একা।
কাঞ্চনা :
সত্যিই উনি পরম একাকী। আমাদের নিয়ে যে ওঁর এই লীলা এ ওঁর অসীম দয়া। তোমার কেন ভয় হয় গৌর-প্রিয়া জানি না, আমার কিন্তু ভয় হয় না। না, না, ভয় হয় বলেই তুমি ব্রজেশ্বরী, গৌরবক্ষ-বিলাসিনী। তুমি যে প্রেমময়ী তাই মধুর রূপ ছাড়া তাঁর অন্য রূপের কল্পনাও করতে পার না। আমরা সাধারণ মানুষ, – তাই দেবতাকে প্রিয়রূপে ভাবতে পারি না।
নিমাই :
যাক। আমি আর পণ্ডশ্রম করে মরি কেন, কাল থেকে টোলের ছাত্রদের বলে দেব, এই ঘরেই তারা ভাগবতের পাঠ নেবে।
কাঞ্চনা :
(চিৎকার করিয়া) মা দেখে যাও, আবার আমাদের জ্বালাতন করছে। তোমার ছেলেকে সামলাও, নইলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।
শচীমাতা :
নিমাই! আবার কেন ওদের সঙ্গে লাগতে গেলে বাবা? ওরা দুটিতে আপনার মনে আলাপ করছে –
নিমাই :
আলাপ নয় মা প্রলাপ, একবার শুনে যাও না এসে।
শচীমাতা :
তা ওরা যা ইচ্ছা বকুক, তোর তাতে কাজ কী বাপু? আমি তখন থেকে কলা আর দুধ নিয়ে বসে আছি – আয় খেয়ে নে।
কাঞ্চনা :
মা, দুধকলা খাইয়ে ওঁকে পুষছ – বুঝবে যখন দংশন করে চলে যাবে।
[ বলিতে বলিতে প্রস্থান।]
...........
শচীমাতা :
লজ্জা কী বউমা, এসো, এ যে আমার নিমুর দাদা, এসে প্রণাম করো।
নিত্যানন্দ :
দোহাই মা লক্ষ্মী, ওটি হতে দিচ্ছিনে। আমার পায়ের ধুলো অত সস্তা নয়। ওই পদ্মফুলের পাপড়ির মতো হাতে কি এই অবধূতের পায়ের ধূলো লাগাতে আছে। যে হাত দিয়ে নারায়ণের সেবা হয়, সেই হাতে পায়ের ধূলা! একবার নদের চাঁদের বামে গিয়ে দাঁড়াও তো মা, আমার সন্ন্যাস সার্থক হোক, জীবন ধন্য হোক দেখে। ওকী, পালালে? আচ্ছা মা লক্ষ্মী, আজ পালালে পালাও, কিন্তু যুগল-মূর্তি আমি দেখবই।
শচীমাতা :
ওমা! ছেলেকে কোলে নিয়ে বসেই আছি, খেতে যে দিতে হবে তা মনেই নেই। আয় বাপ, তোরা দু-ভাইয়ে এসে খাবি। ঈশান!
ঈশান :
(অশ্রু গদগদ কণ্ঠে) মা?
শচীমাতা :
একী বাবা ঈশান, তুমি অমন ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে কেন? এ যে আমার বিশ্বরূপ, আমার বিশু, নিমাই ওকে ধরে এনেছে। চিনতে পারছ না? আমি দেখি গিয়ে কী আছে ঘরে।
ঈশান :
চিনেছি, মা। তবে আর কাউকে বিশ্বাস হয় না। তুমি যাও মা, আমি জায়গা করে দিচ্ছি।
নিত্যানন্দ :
ঈশানদা, আমাকে সন্দেহ হচ্ছে বুঝি?
ঈশান :
সত্যি করে বলো দেখি, তুমি কে? তুমি বিশ্বরূপ না বিষ-রূপী কেউ?
নিমাই :
ঈশানদা-র দিবারাত্রির সন্দেহ আর ভয়। এ বাড়িতে যে আসে তাকেই সে চোর বলে সন্দেহ করে।
নিত্যানন্দ :
ওর সন্দেহ ভুল নয় কানাই – থুড়ি – প্রভু, থুড়ি নিমাই। সোনার গৌরকে চুরি করার জন্যে ত্রিভুবনের চোর যে নদিয়ায় এসে জুটবে, তাতে আর সন্দেহ কী?
ঈশান :
ঠিক – ঠিক বলেছে সন্ন্যাসী ঠাউর। শুধু চোর-ডাকাত বাটপাড়-জোচ্চোরে নদিয়া ভরে উঠল – সকলের চোখ আমাদের এই সোনার গৌরাঙ্গের উপর। ডাকিনী-যোগিনী, ভূত-পেরেত, পিশাচ,যক্ষি-রক্ষি সব যেন জোট বেঁধে এসেছে। কী বলব, আমার হাতের খেঁটে লাঠি আমার হাতেই রইল, তা দিয়ে একটা মাথা ভাঙতে পারলেও আমার মনের জ্বালা কিছু কমত। যাই, খাবার জায়গাটা করে দিই গিয়ে।
নিত্যানন্দ :
(গান)
কানাইরে কই তোর চূড়া বাঁশরি!
তুই নাকি সেই নন্দদুলাল
এলি নদিয়ায় ব্রজ পাশরি?
নিমাই :
(গান)
কী পুছসি আমারে ভাই
এবার চূড়া বাঁশরি নাই।
ব্রজের খেলা বাঁশির তান
নদের খেলা হরি-গান;
ব্রজের বেশ ধড়া চূড়া, নদের বেশ কৌপীন পরা
ব্রজের খেলা রাখাল হয়ে, নদের খেলা ধূলি লয়ে।
নিত্যানন্দ :
(গানে) নদিয়াতে বিষ্ণুপ্রিয়া, ব্রজের রাই কিশোরী॥
..........
নিমাই :
নিত্যানন্দ ঠাকুর! তোমায় বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু চুপ করে সুবোধ বালকের মতো খেয়ে দেয়ে সুড়সুড় করে ফিরে আসবে। উৎপাত কোরো না যেন।
নিত্যানন্দ :
শ্রীবিষ্ণু! শ্রীবিষ্ণু! পাগলেই চঞ্চলতা করে। তুমি নিজে পাগল কিনা, তাই সকলকেই পাগল মনে কর।
ঈশান :
এই যে মাতোয়াল ঠাকুর এসেছেন। দাঁড়াও, ছিচরণ দুটো ধুইয়ে দিই, তারপর বাড়িতে ঢোকো। (পা ধোয়াইতে ধোয়াইতে) ওই পায়ের তো আর গুণের ঘাট নেই, ত্রিভুবনের বনের ময়লা কাদা পাঁক মেখে এসেছেন। পৃথিবীতে যা কিছু নোংরা সব বুঝি তোমার ছিচরণে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বৈতরণি পার হবার বুঝি আর কিছু পেলে না সব, এই অবধূতের চরণতরি ছাড়া?
শচীমাতা :
এই যে দুই ভায়ে এসেছ। আমি কখন থেকে পথ চেয়ে বসে আছি। বউমা, ভাত আনো।
নিতাই :
মা! এ ভাতের থালা না পর্বত? তুমি ভুল করেছ মা, আমি তো গিরি-গোবর্ধন ধারণ করিনি, আর বিশ্বম্ভরও আমি নই, বিশ্বম্ভর ওই নিমাই।
শচীমাতা :
নে এখন ফষ্টিনষ্টি রেখে খেতে বস দেখি। তুই-ই বা কীসে কম বাবা? নিমাই বিশ্বম্ভর, তুইও তো আমার বিশ্বরূপ। একী! একী! তোদের দুজনের অন্ন তিন ভাগ হল কেন? তোদের মাঝে কে ওই পঞ্চমবর্ষের দিগম্বর কৃষ্ণবর্ণ শিশু। ওই সুন্দর শিশুকেই তো কাল স্বপ্নে দেখেছিলাম। একী, কোথায় নিমাই, নিতাই কই! চতুর্ভুজ কৃষ্ণ ও শুক্লবর্ণ পরম মনোহর এক শিশু – হস্তে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম-শ্রীহল-মুষল – বক্ষে শ্রীবৎস কৌস্তুভ, কর্ণে মকরকুণ্ডল – তাদের জায়গায় বসে আহার করছে। ওই–ওই– আমার পুত্র, পুত্রের হৃদয়ে আমার বধূমাতা – বিষ্ণুবক্ষে লক্ষ্মীর মতো বিরাজ করছে। একী মায়া! একী স্বপ্ন! নারায়ণ! নারায়ণ! একী খেলা তোমার? (মূর্ছা)
নিমাই :
অবধূত ঠাকুর, মা মূর্ছা গেলেন, ধরো! ধরো!
ঈশান :
মাতোয়াল ঠাকুর, ধরা পড়েছ। ধরা পড়েছ! আমি দেখেছি আমি চিনেছি তোমাদের! একী দেখলাম – একী দেখলাম আমি! আমি এখনও বেঁচে আছি তো? আমার জ্ঞান আছে তো? ঠাকুর! দাও, দাও তোমার উচ্ছিষ্ট আমার মাথায় মাখো, মুখে মাখো। তোমার পা ধোওয়া জল আমি ফেলিনি – রেখে দিয়েছি ঘড়ায় করে, ওকি আমি ফেলতে পারি? এই – এই আমি তা সব খেয়ে ফেলব, এক ফোঁটাও কাউকে দিচ্ছিনে। (জল পান) আজ চতুর্দশলোকে আমার মতো ভাগ্যবান আর কে আছে? অমৃত – অমৃত-কলশ পেয়েছি আমি – অমৃত-কলশ। (মূর্ছা)
..........
[ নিত্যানন্দের গান ও নৃত্য ]
এই যুগল-মিলন দেখব বলে ছিলাম আশায় বসে।
আমি নিত্যানন্দ হলাম পিয়ে মধুর ব্রজ-রসে।
রাই বিষ্ণুপ্রিয়া আর কানাই গউর
হেরো নদিয়ায় যুগল রূপ সুমধুর
তোরা দেখে যা দেখে যা, মধুর মধুর।
মধুর রাই আর মধুর কানাইর দেখে যা
দেখে যা মধুর মধুর।
[তাণ্ডব নৃত্য]
ঈশান :
এই হয়েছে! মাতোয়াল ঠাকুর আবার খেপেছে। ও বাব্বাঃ! ঠাকুর যে একেবারে দিগম্বর মূর্তিতে নেচে বেড়াচ্ছে গো! ও দাঠাউর! ধরো ধরো! সন্ন্যাসী ঠাউর যে ন্যাংটা হয়ে নেচে বেড়াচ্ছে গো। মুখ দিয়ে ফেনা উঠছে যে! বুড়ো লোক আমি কি সামলাতে পারি এই পাগলা হাতিকে!
নিমাই :
(হাসিয়া) একী হচ্ছে প্রভু! ছিঃ ! ছিঃ ! নাও কাপড় পরো।
নিতাই :
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এইবার আমি যাব।
নিমাই :
আরে, যাওয়ার কথা কে বলেছে ? কাপড় পরো।
নিতাই :
আর খেতে পারব না। আমার ক্ষুধাতৃষ্ণা মিটে গেছে।
নিমাই :
আরে, আমি কী বলছি আর তুমি কী উত্তর দিচ্ছ।
নিতাই :
এই নিয়ে দশবার গেলুম, আর যেতে পারব না।
নিমাই :
আমার মাথা আর মুণ্ড! তাতে আমার কী দোষ?
নিতাই :
মা এখানে নেই। (উন্মত্ত হাসি ও নৃত্য)
শচীমাতা :
নিতাই, ঘরে এসো, সন্দেশ খাবে।
নিতাই :
?
বসন – বসন দে। মা ডাকলেন – শিগগির কাপড় আন।
শচীমাতা :
হল ভালো, ছিল এক পাগল, তার দোসর জুটল এসে উন্মাদ।
নিতাই :
তোমার বাবা পাগল, তোমার মা পাগল, তোমাদের গুষ্টি পাগল মা, তা আর ছেলেরা কোন ভালো হবে?
চরিত্র
সম্পাদনাপুরুষ :
শ্রীগৌরাঙ্গ (নিমাই), শ্রী নিত্যানন্দ, শ্রীঅদ্বৈত, শ্রীবাস, মুকুন্দ, গদাধর, ঈশান, সনাতন মিশ্র, চন্দ্রশেখর আচার্য, যাদব, বুদ্ধিমন্ত।
স্ত্রী :
শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া, শচীমতা, সর্বজয়া, মালিনী, সীতাদেবী, কাঞ্চনা, অমিতা, নদীয়া নাগরীগণ, কুল-ললনাগণ।