মাহফুজ আনাম

বাংলাদেশী সাংবাদিক

মাহফুজ আনাম (জন্ম: জুন ১৮, ১৯৫০) বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ইংরেজি ভাষার দৈনিক সংবাদপত্র দ্য ডেইলি স্টারের প্রকাশক ও সম্পাদক। তিনি বাংলা ভাষার দৈনিক সংবাদপত্র প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক ছিলেন। তিনি বিনোদন পত্রিকা পাক্ষিক আনন্দধারা এবং সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকার প্রকাশক। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশান নামক একটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এই সংস্থাটি নিউ ইয়র্কভিত্তিক ফোর্ড ফাউন্ডেশান নামক সংস্থার সহযোগিতাপুষ্ট। ১৯৭৭-১৯৯০ এই সময়কালে তিনি জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কোর বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। তিনি ২০২২-২৩-এ এশিয়া নিউজ নেটওয়ার্কের (এএনএন) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

বাংলাদেশে এক ধরনের অদ্ভুত প্রবণতা দেখা যায়। কেউ যখন নতুন কিছু শুরু করেন, তার দেখাদেখি শত শত মানুষ সেটা অনুকরণ করে নষ্ট করে ফেলেন।
  • আমাদের পেশাটি সমাজের কল্যাণে নিবেদিত। আমরা জনগণ ছাড়া আর কারো সেবা করি না; কোনো ক্ষমতা, সম্পদ বা প্রভাবের কাছে মাথা নত করি না এবং কেবলমাত্র সত্যই আমাদের পাথেয়। একজন সৈনিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে যেমন জানে যে দেশের জন্য প্রয়োজনে তাকে প্রাণ দিতে হবে, তেমনি আমরাও এই পেশায় এটা জেনেই যোগ দেই যে আমাদেরকে সব ধরনের হয়রানি, অপমান, শাস্তি, কারাবাস, এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখিও হতে হবে—এই মৃত্যুর ধারা আবার ক্রমশ বাড়ছে—এবং এর সবই পাঠকদের সেবায়। তবে, একজন সৈনিককে তখনই আত্মদান করতে হয় যখন তার দেশ কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে আছে কিংবা তার দেশের ভেতরে কোনো গুরুতর সংকট চলছে। কিন্তু একজন সাংবাদিকের হেনস্তা হওয়ার ও শাস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা নিত্যদিনের।
  • ঔপনিবেশিক আমলে প্রচলিত একটি প্রবাদ ছিল এরকম, 'সরকার কা মাল, দরিয়া ম্যায় ঢাল (যেহেতু এটা সরকারের টাকা, একে সমুদ্রে ফেলে দিলেও কোনো সমস্যা নেই)।' বর্তমানে সমুদ্রে না ফেলে টাকা পকেটে ভরা হয়।
  • দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করে স্বচ্ছ প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি আমাদের কানে যেন ভাঙা ক্যাসেটের মতো বাজে। কারণ, কথাগুলো এতো বেশি বলা হয়েছে যে এর বিশ্বাসযোগ্যতাই হারিয়ে গেছে। তারপরও আমরা এগুলো শুনতে চাই। কারণ, অন্তহীন বিশ্বাস এবং অনেকের মতে নির্বোধের মতো প্রত্যাশা নিয়ে আমরা অপেক্ষায় থাকি যে এবার বুঝি সত্যি সত্যিই কথাগুলো বাস্তবে রূপ নেবে।
    • প্রধানমন্ত্রীর দূর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার প্রতিশ্রুতির পর, ১৯ জানুয়ারী ২০২৪, উদ্ধৃত: দ্য ডেইলি স্টার বাংলা
  • বাংলাদেশে এক ধরনের অদ্ভুত প্রবণতা দেখা যায়। কেউ যখন নতুন কিছু শুরু করেন, তার দেখাদেখি শত শত মানুষ সেটা অনুকরণ করে নষ্ট করে ফেলেন।
  • ৫২ বছরের সাংবাদিকতা (১৯৭৩ সালের মে মাসে আমি বাংলাদেশ অবজারভারে যোগ দেই) এবং ৩০ বছর দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তরুণ সহকর্মীদের প্রতি আমার শুধু এটুকুই বলার আছে—সাংবাদিক হিসেবে গর্বিত হোন (অহংকারী নয়) এবং এই পেশাকে আরও গৌরবান্বিত করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করুন। এই গর্ব যেন আমাদের পেশা নিয়ে সাধারণ মানুষকেও আরও গর্বিত করে তুলতে পারে, সেই চেষ্টা করুন।
  • 'স্মার্ট বাংলাদেশে' স্মার্ট শিক্ষার্থী প্রয়োজন। স্মার্ট শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষক এবং স্মার্ট শিক্ষকদের প্রয়োজন স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়। যাতে তারা মুক্ত, সৃজনশীল ও গবেষণাবান্ধব পরিবেশে কাজ করতে পারেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের বুদ্ধিজীবী, গবেষক, লেখক, সমালোচক, উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা ও নেতা তৈরি করতে পারেন। তারা পারবেন একুশ শতকের হাত ধরে আসা সব ধরনের সুযোগকে বাস্তবতায় রূপান্তর করে আমাদের দোরগোড়ায় নিয়ে আসতে।
  • ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য থেকে যা বোঝা যায় তা হলো, দিল্লির সমর্থন থাকায় আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় থাকছে। এটা ছাড়া 'চিন্তার কিছু নেই' বলার আর কী অর্থ হতে পারে? এমন একটি কথা আমাদের দেশ ও মানুষের সার্বভৌমত্ব ও সম্মান নিয়ে কী বার্তা দেয়? প্রতিবেশী দেশ যদি নির্ধারণ করে দেয় যে এ দেশের ক্ষমতায় কে থাকবে, তাহলে সরকারের স্বাধীনতা সম্পর্কে কী বার্তা পাওয়া যায়? তাহলে আমাদের নির্বাচনের যৌক্তিকতা কী?
  • গণতন্ত্রে ফেরার ৩২ বছর পরে এসে আমাদের উচিত ছিল রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কিছুটা হলেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সহনশীলতা গড়ে তোলা। গণমাধ্যমকে দেশের 'ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ' করার অভিযোগে অভিযুক্ত করার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করা হয় না। কিন্তু, তখন কি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না, যখন আমাদের সবচেয়ে বড় ২ রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে আলোচনা না করে শুধু হুংকার দেয়, আপসের পরিবর্তে দোষারোপ করে, যেকোনো আলোচনা শুরুর আগেই শর্ত দিতে থাকে এবং বারবার প্রমাণ করে যে তাদের মধ্যে ছাড় দেওয়ার মতো মানসিক পরিপক্বতা এখনো তৈরি হয়নি? এই ছাড় দেওয়ার সক্ষমতা ও মানসিকতা এখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। এর অভাবে সমাজে শান্তি, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক বিবর্তন হুমকির মুখে পড়ছে।
  • সাংবাদিকদের মনে প্রশ্ন ওঠা উচিত, জনমানুষের কাছে সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্য বাংলা দৈনিকটিকে হেয় করার জন্য আমাদেরই অনেকে কেন এত উঠে-পড়ে লাগলেন? প্রথম আলোর 'ভুলের' বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করার সময় কি সাংবাদিকতার নীতি বজায় রাখা হয়েছে? প্রথম আলোর তথাকথিত 'উদ্দেশ্য' কি তাদের অনুসন্ধানে প্রমাণসহ উঠে এসেছে? হঠাৎ কেন 'মতামত'কে 'তথ্য' হিসেবে বিবেচনা করা শুরু হলো? একটি সংবাদপত্রের দীর্ঘ ইতিহাস বিবেচনায় না নিয়ে কেবল দুএকটা ভুল দিয়ে কেন বিচার করা হলো এবং পরবর্তীতে কেন সমালোচকরা কোনো তথ্যের সূত্র না দিয়েই নিজেদের মতো করে সেটি বিশ্লেষণ করলেন?
  • স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের ইতিহাস নতুন নয়। তবে দুঃখের বিষয় হলো, একটি সরকার দেশের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি করেও এই গোষ্ঠীকে অনৈতিক সহায়তা দিচ্ছে এবং বারবার তাদের ছাড় দিয়ে চলেছে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কথা বলে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা এই গোষ্ঠীকে সাহায্য করার জন্যই। এর পরিণতিতে আমাদের অর্থনীতির এই অবস্থা।
  • শান্ত সমুদ্রে নয়, উত্তাল সমুদ্রে ঝড় মোকাবিলা করে জাহাজ কীভাবে চলছে, সেই হিসাবে একটি দেশের অর্থনীতির অবস্থা পরিমাপ করা হয়। আমাদের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়ে 'ধরা ছোঁয়ার বাইরে' চলে যাওয়া এই গোষ্ঠিী আন্তর্জাতিক ঝড়ের মোকাবিলা আরও কঠিন করে তুলছে। এবার সময় এসেছে, 'ধরা ছোঁয়ার বাইরে' চলে যাওয়া এই গোষ্ঠীকে ধরার।
  • একজন বোকার পক্ষেই শুধু বুঝতে না পারার কথা যে, আসন্ন নির্বাচনে জেতার জন্য তিনি ভারতের সহায়তা চেয়েছেন। তার অনুরোধ কি এটাই বোঝায় না যে, আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনা নিজের যোগ্যতায় জয় লাভ করতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে তিনি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন? তিনি কি এই বক্তব্যের তাৎপর্য বুঝতে পেরেছেন? এখন যদি বলা হয় আগামী নির্বাচন কেমন হবে, সেটা বোঝা গেছে— তাহলে তিনি এই সমালোচনার কী জবাব দেবেন?
  • ট্রাস্টি বোর্ডের কিছু সদস্য বছরে এসব ফি বাবদ করসহ প্রায় দেড় কোটি টাকা তুলে নিতেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় বাধ্য হয়েই সেই অর্থ পরিশোধ করতো। অনেক সদস্যের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ব্যক্তিগত কার্যালয় রয়েছে। সেখানে বসে তারা শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের খুঁটিনাটি কাজের সরাসরি তদারকি শুরু করেন, যা উপাচার্যের ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

তার সম্পর্কে উক্তি

সম্পাদনা
  • মাহফুজ আনাম বাংলাদেশের একজন সেরা সাংবাদিক ও সম্পাদক। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের অত্যন্ত সফল ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর প্রকাশক এবং ব্যবস্থাপনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপকও। বাংলাদেশের অস্থির রাজনীতি এবং দুর্বল সংবাদমাধ্যমের পরিসরে এ দুইয়ের সমন্বয় দুর্লভ। আর বর্তমান সময়ে একটি সফল পত্রিকা গড়ে তোলার পেছনে এত ধরনের দায়িত্ব পালন করার মতো ব্যক্তির অভাব আমরা প্রতিনিয়ত অনুভব করি। সেখানে মাহফুজ আনাম একই সঙ্গে কয়েক প্রজন্মের সাংবাদিককে নিয়ে সামনে থেকে সফলতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
  • এক-এগারোর সময় ডেইলি স্টার সম্পাদক ডিজিএফআইয়ের চাপে পড়ে যে সংবাদ ছেপে ভুল করেছিলেন বলে স্বীকার করেছেন ৮ বছর পর তিনি কি শুধুই বিবেকের তাড়নায় নাকি নতুন কোনও চাপে সেই সত্যটি স্বীকার করেছেন, তাও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। তবে শুধু ভুল স্বীকার করলেই দায় মুক্তি হবে না। ভুল স্বীকার করে ডেইলি স্টার সম্পাদক বরং আরেকটি ভুল করলেন।
    • সাংবাদিক তানভীর আহমেদ, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬-এ প্রকাশিত নিবন্ধে, উদ্ধৃত: বাংলা ট্রিবিউন
  • তবু দীর্ঘকাল পরে হলেও মাহফুজ আনাম তার সাংবাদিকতা সম্পর্কে যে ভুল স্বীকার করেছেন, সে জন্য তাকে অভিনন্দন জানাই। তার এই ভুল স্বীকারের মধ্যেও একটা সাংবাদিক সততা ও বিবেক বুদ্ধির আভাস আমি পেয়েছি। যে ভুল তিনি করেছেন তা তার একার ভুল নয়। দেশে বিগ বিজনেস ও একশ্রেণীর বিগ এনজিও গুড গভর্নেন্সের নামে অগণতান্ত্রিক ও অরাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার যে চক্রান্ত শুরু করেছিল এবং যে চক্রান্তের সহায়ক শক্তি হিসেবে খাড়া হয়েছিল একটি তথাকথিত সুশীল সমাজ এবং একটি তথাকথিত নিরপেক্ষ মিডিয়া গ্রুপও, তারই চক্রে বাধা পড়েছিলেন তিনি। দশ চক্রে ভগবান ভূত হয়েছেন। মাহফুজ আনাম তার ভুল স্বীকার করার মতো সাহস দেখিয়ে যদি এই দশ চক্র থেকে নিজেকে মুক্ত করতেও সাহস দেখান তাহলে তাকে শাবাশ দেব। বলব, তিনি যেন বাংলাদেশে বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার জয় পতাকা তুলে ধরার কাজে সকলকে পথ দেখান।

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা