মৃণাল সেন
মৃণাল সেন (১৪ মে ১৯২৩ - ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮) ছিলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও লেখক। ১৯২৩ সালের ১৪ মে মৃণাল সেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত পূর্ব বঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) ফরিদপুরের একটি শহরে বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ফরিদপুরে থাকাকালীন সময়ে তিনি সেখানেই উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি পড়াশোনার জন্য কলকাতায় আসেন এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা পড়াশোনা করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সঙ্গে যুক্ত হন। যদিও তিনি কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন নি। চল্লিশের দশকে তিনি সমাজবাদী সংস্থা আইপিটিএর (ইন্ডিয়ান পিপ্লস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন) সঙ্গে যুক্ত হন এবং এর মাধ্যমে তিনি সমমনভাবাপন্ন মানুষদের কাছাকাছি আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবার পর তিনি একজন সাংবাদিক, একজন ওষুধ বিপননকারী এবং চলচ্চিত্রে শব্দ কলাকুশলী হিসাবে কাজ করেন।
উক্তি
সম্পাদনা- “খণ্ডহর একটি অভিযাত্রার গল্প; ক্ষণিকের সাক্ষাৎ এবং তার পরিণতিতে গড়ে ওঠা আনুগত্য ও প্রতারণা, আকর্ষণ ও পলায়ন, মায়া ও নির্মমতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো এক জটিল সম্পর্কের আখ্যান, যার সবটাই সংঘটিত হয় আশ্লেষাময় এক ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে।” — মৃণাল সেন, "খণ্ডহর : মৃণাল সেনের উক্তি ও তাঁর পরিণত মানস" [১]
- “আমি একটি সামাজিক প্রাণী, এবং যেমন, আমি আমার চারপাশের জিনিসগুলিতে প্রতিক্রিয়া জানাই - আমি তাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব এড়াতে পারি না। আমি যখন একজন পুরুষ এবং একজন মহিলার সম্পর্কের উপর একটি চলচ্চিত্র তৈরি করি, তখন আমি একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে সম্পর্কটিকে বোঝার চেষ্টা করি।” — মৃণাল সেন,Indian Cultural Forum, "Mrinal Sen: “A perfect combination of a wise-old-man and completely young at heart” – Indian Cultural Forum" [২]
- “একের মধ্যে সমষ্টির ইচ্ছাপূরণ আর নয়, একের মধ্যে একেরই সংশয় ও সংকটের কথা বলা উচিত। এবং একের সংকটের মধ্য দিয়েই সমাজের আত্মিক সংকটের কথা বলা। ১৯৭৯ সাল থেকেই আমি তা করতে চেষ্টা করেছি, বলছি একান্ত আপন কথা, আপন সংশয়, সংকট ও স্ববিরোধিতার কথা এবং সেই সবকিছুর আড়ালে এক নতুন উপলব্ধির কথা, যে উপলব্ধির মধ্যে ইঙ্গিত পাই বিশ্বাসের, প্রত্যয়ের, এককের এবং সমষ্টির।” — মৃণাল সেন, "খণ্ডহর : মৃণাল সেনের উক্তি ও তাঁর পরিণত মানস" [৩]
- “আমি কুরোসাওয়া নই, আমি সত্যজিৎ রায় নই, আমি গডার্ড নই, যারা স্কেচ আঁকাতে বিশ্বাসী। আমি তা করতে পারি না। আমি একটি লাইনও আঁকতে পারি না। আমার চলচ্চিত্র এক ধরনের থিসিস।” — মৃণাল সেন, "গুরুচণ্ডা৯ : হরিদাস পাল : মৃণাল সেন : এক উপেক্ষিত চলচ্চিত্রকার" [৪]
- “... বাংলা চলচ্চিত্র সম্পর্কে যে সংকটের কথা বলা হয় অর্থাৎ আর্থিক সংকট অর্থাৎ যে সংকট আসে জনপ্রিয়তার অভাব থেকে – সেই সংকট কাটাতে গেলে প্রথমেই যা করণীয় তা হল — ১) কম পয়সায় ছবি তোলা অর্থাৎ স্টার সিস্টেমকে বর্জন করা এবং অকারণ, অহেতুক, অসংগত জাঁকজমক বর্জন করা; ২) চলচ্চিত্রের বাজারের পরিধি বাড়ানো অর্থাৎ আঞ্চলিক গণ্ডি ডিঙিয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা।” — মৃণাল সেন, চলচ্চিত্র ভূত বর্তমান ভবিষ্যৎ, "গুরুচণ্ডা৯ : হরিদাস পাল : মৃণাল সেন : এক উপেক্ষিত চলচ্চিত্রকার" [৫]
- “এমনই একটা বিশ্বাস থেকে ’৬০-’৭০ দশকের সন্ধিক্ষণে নকশাল আন্দোলনকে দেখেছি, তা নিয়ে ভেবেছি, জড়িয়ে পড়েছি। এ-দেখার মধ্যে বেহিসেবিপনা ছিল, এ ভাবনার ভিতরে বেপরোয়া ভাবনা ছিল, এভাবে জড়িয়ে পড়ায় অনেকটাই আবেগ যুক্ত ছিল। কিন্তু এসবের মধ্যে আর কোনো হিসেব ছিল না, নির্লিপ্ত শীতল পর্যবেক্ষণ ছিল না, ছক কষার কোনো চেষ্টা ছিল না। নকশাল আন্দোলনকে সামনে রেখে কোনো অঙ্কটঙ্ক কষে ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১, কিংবা পদাতিক বানাইনি। ওই অস্থির সময়টার তাপ যখন যেভাবে মনের ওপর ছাপ ফেলেছে, সেভাবেই একের পর এক ছবিগুলো করে গেছি।” — মৃণাল সেন, "গুরুচণ্ডা৯ : হরিদাস পাল : মৃণাল সেন : এক উপেক্ষিত চলচ্চিত্রকার"[৬]
- “কোরাস’ আমাদের ছবিতে শেষ পর্যন্ত এসে দাঁড়ায় একটি ব্যাপক অর্থে — বিশাল মানুষের এক বিশাল ইচ্ছা — বিস্তর মানুষ, অনেক কথা, বহু লড়াই, সব যখন একীভূত হয়ে যায়, একটা সাংগীতিক মুহূর্তের সৃষ্টি হয়, অর্থাৎ একটা collective আবেগ বা ইচ্ছা — তারই নাম ‘কোরাস’।” — মৃণাল সেন, "গুরুচণ্ডা৯ : হরিদাস পাল : মৃণাল সেন : এক উপেক্ষিত চলচ্চিত্রকার" [৭]
- “যেভাবে এতকাল বলা হয়েছে, সেইভাবে যদি না বলে অন্যভাবে বলা যায় তাহলে বলার চেহারাটাও পাল্টে যায়। বলা তো হয়ে গেছে প্রচুর কথা এবং সে কথাগুলোই তো আমরা বারবার বলছি। তাই চলতি লিনিয়ার স্ট্রাকচারের বাইরে যেতেও মন চায় প্রায়ই।” — মৃণাল সেন,"গুরুচণ্ডা৯ : হরিদাস পাল : মৃণাল সেন : এক উপেক্ষিত চলচ্চিত্রকার" [৮]
- “ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ দেখে অনেকে মনে করেন, রাজনৈতিক ছবি বানানো অসম্ভব। এই প্রসঙ্গে, আপনি কি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন নাকি রাজনীতি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন?” — মৃণাল সেন, Indian Cultural Forum, "Mrinal Sen: “A perfect combination of a wise-old-man and completely young at heart” – Indian Cultural Forum" [৯]
- “আমি গডার্ডের সাথে একমত নই যখন তিনি বলেন যে সিনেমা একটি বন্দুক। এটা খুব রোমান্টিক একটি অভিব্যক্তি. আপনি একটি "পোটেমকিন" তৈরি করে একটি সরকার বা একটি সিস্টেমকে ধ্বংস করতে পারবেন না। আপনি দশটি "পোটেমকিনস" দিয়েও এটি করতে পারবেন না। আপনি যা করতে পারেন তা হল এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যেখানে আপনি এমন একটি সমাজ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন যা অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠছে।” — মৃণাল সেন, Indian Cultural Forum, "Mrinal Sen: “A perfect combination of a wise-old-man and completely young at heart” – Indian Cultural Forum" [১০]
- “বড় শহরে আসতেই এক ধরনের ভয় আঁকড়ে ধরল। আমি একটি ভিড়, একটি বিশাল ভিড়ের সম্মুখীন। মনে হল আমি হারিয়ে গেছি। আমি অনুভব করছি যে আমি ভিড়ের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আছি - একটি বেনামী, আত্মমগ্ন, উদাসীন ভিড়ের ঝাঁক, এমনকি ভয়ঙ্কর এবং দানবীয়। আমার বাবা-মায়ের প্রিয় এবং আমার ছোট শহরের শিক্ষকদের পছন্দের আমি, এখন একদমই অচেনা, শূন্যতার একটি হতাশাগ্রস্থ অনুভূতিতে তীব্রভাবে ভুগছি। যতক্ষণ না জিনিসগুলি ভিন্ন প্রমাণিত হয়,” — মৃণাল সেন, Indian Cultural Forum, "Mrinal Sen: “A perfect combination of a wise-old-man and completely young at heart” – Indian Cultural Forum" [১১]
মৃণাল সেন সম্পর্কে উক্তি
সম্পাদনা- “মৃণাল সেনের প্রয়াণে ভারতীয় সিনেমার একটি মহৎ পর্যায়ে পর্দা পড়ে গেছে” — সলিল ত্রিপাঠী, Indian Cultural Forum
- “বাবা মারা যাবার পর তাঁর টেবিল ঘাঁটতে গিয়ে একটা খাতা নজরে এলো. এক লাইন লেখা. কবে লিখেছিলেন তা সঠিক জানা নেই, তবে শেষ কয়েক মাসের মধ্যেই হবে। একটা লাইন --তুমি ভালো আছো? আমি ভালো নেই” — কুণাল সেন,""আমি ভালো নেই", কাঁপা হাতে লেখা মৃণাল সেনের একটা লাইন জন্ম দিল হাজারো প্রশ্নের" [১২]
- “তারা আমার সাথে প্রায় একই সময়ে শুরু করেছিল, ঋত্বিক এবং মৃণাল’। কিন্তু এ কথাও বলেছেন পাশাপাশি ‘আমি মনে করি
তারা আমার থেকে খুব আলাদা কিন্তু খুব শক্তিশালী, চলচ্চিত্রগুলি তৈরি করছিল।” — সত্যজিৎ রায়, "গুরুচণ্ডা৯ : হরিদাস পাল : মৃণাল সেন : এক উপেক্ষিত চলচ্চিত্রকার"[১৩]
- “সত্যজিৎ সমন্বিত, সুষম, শীলিত, কমনীয়। ঋত্বিক মন্থর, তীব্র, শিথিল, অনমনীয়। অন্যদিকে মৃণাল দ্রুত, তীক্ষ্ণ, তৎপর ও নমনীয়।” — ধীমান দাশগুপ্ত, "গুরুচণ্ডা৯ : হরিদাস পাল : মৃণাল সেন : এক উপেক্ষিত চলচ্চিত্রকার"[১৪]
- “'নীল আকাশের নিচে' তোমার
নীরব অভিজ্ঞান,
নিজের মতে, নিজের পথে
বিজয় অভিযান।
অটল ছিলে কথায় এবং
প্রতিদিনের কাজে;
ভুঁইফোড় এরা তোমায় দেখে
মুখ লুকাতে লাজে!
তোমার শোকে সারাটা দিন
কাঁদছিল কলকাতা;--
মাটির উপর পা-দুখানি,
আকাশ-ছোঁয়া মাথা।” — অরি মিত্র, [১৫]