শহীদুল্লা কায়সার

বাংলাদেশী সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী

শহীদুল্লা কায়সার (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২৭ - ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১) ছিলেন একজন বাংলাদেশী সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী। তার প্রকৃত নাম ছিল আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লা। তিনি ১৯৬৯ সালে উপন্যাসে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে সাংবাদিকতায় মরণোত্তর একুশে পদক এবং সাহিত্যে ১৯৯৮ সালে গল্পে অবদান রাখার জন‍্য মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার স্থানীয় সহযোগী আল-বদরের হাতে অপহৃত হন। ধারণা করা হয় যে, অপহরণকারীদের হাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

  • সবাই যদি চলে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করবে কে? আর এই তথ্যগুলো আমার উপন্যাসের কাজে লাগবে।

রাজবন্দীর রোজনামচা (২০০০)

সম্পাদনা
  • রাত এগারোটা পেটানোর পর নিম-আঁধার নিম-আলোর পরিবেশে এমনই বসে থাকতে আমার ভালো লাগে। ভালো লাগে কেননা দিনরাত্রির মাঝে এটুকুই মাত্র সময় যখন নিজেকে নিয়ে সুন্দর একটি নির্জনতার নীড় গড়তে পারি, একান্তভাবে নিজেকে নিয়ে বসে থাকটি পারি চুপচাপ। বুঝি নির্জনতার এই অবকাশটুকুর দিকে চেয়েই সন্ধ্যারাত্রিরা তর তর করে কেটে যায় আমার। টের পাই না।
    • পৃষ্ঠা ১৭।
  • পৃষ্ঠা জীর্ণ পাতার বেশ ছেরে জীবন এগুলো আর এক ধাপ কিশলয়-সার্থকতার পানে।পৃষ্ঠা
    • কবি, পৃষ্ঠা ৩১।
  • পৃষ্ঠা কই বক্তৃতার বেলায় তো কেউ কম যাইনা। ঢক্কা-নিনাদে ঘোষণা দেই, দেশহিতে সর্বস্ব ছেড়েছি, কত জেল জুলুম সয়েছি। কিন্তু এই তার নমুনা? এতগুলো রাজবন্দী গরমে সেদ্ধ হয়ে চলছে আর আমি কিনা শুয়ে শুয়ে পাখার হাওয়া খাচ্ছি।পৃষ্ঠা
    • হাসিব, পৃষ্ঠা ৩২।
  • ...কেননা এমনও দুচার জন রয়েছেন যারা সর্বস্ব ত্যাগ করেও একটুখানি লোভ বাঁচিয়ে রাখেন জীবনে। সে লোভটা হল ধূমায়িত এক পেয়ালা চা আর জ্বলন্ত একটা বিড়ি।
    • পৃষ্ঠা ৩৪।
  • দেখ দেখ, এমন পেলব রমণীয় আকাশ কারাগারে দেখেছিস কখনো? হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয় কালাম। ওর চোখ অনুসরণ করে দৃষ্টিটাকে পাঠিয়ে দিলাম বাইরে। রাজহাঁসের পালকের মতন শাদা আকাশ। মনে হয় তুলতুলে নরম। আর মনে হয়, বুঝি অনেক নীচে নেমে এসেছে আকাশটা। হায়তো পূর্ণিমা আমোদিত এই পৃথিবীরই একটি আলিঙ্গনের প্রত্যাশায়।
    • পৃষ্ঠা ৩৯।
  • পৃষ্ঠা দেখ চেয়ে পর্ণশশী সেই রবি ঠাকুরের সাধা মেঘের ভেলায় চড়েছে। বুঝি বিহারে চলেছেন।পৃষ্ঠা
    • কালাম, পৃষ্ঠা ৪২।
  • বৌদ্ধ পূর্ণিমার শুভ্রতামাখা অংগনের দিকে চেয়ে থাকি নির্নিমেষ।
    অঙ্গনজুড়ে উজ্জ্বল রাত্রির নিরঙ্কুশ রাজত্ব দরাগত কোন সংগীতের মত এখনো বেজে চলেছে আমার কানে– শুদ্ধ দৃষ্টি, শুদ্ধ স্মৃতি পুর্ন্য কর্ম সত্য ধ্যান ---------- ।
    • পৃষ্ঠা ৪৫।
  • এ প্রাণ রবি ঠাকুরের কবিতায়। এ প্রাণ রবীন্দ্র সংগীতের সূক্ষ্ম কারুকর্মিতায়, শব্দ পদ তানের বিচিত্র ঝংকারে। এ প্রাণ বিশ্বময় আপনাকে ছড়িয়ে দিয়েছে সহস্রধারায়, অজস্র চরিতার্থতায়। রবি ঠাকুরের মতো আর কোন কবি এ সবুজ প্রাণকে আপন আত্মার আঁধারে একান্ত করে ধরতে পেরেছিলেন?
    • পৃষ্ঠা ৪৭।
  • মনে হয় এই মাস এই গ্রীষ্ম ঋতু ছাড়া অন্য কোন মাসে অন্য কোন ঋতুতেই সার্থক হত না রবীন্দ্রজন্ম।
    • পৃষ্ঠা ৪৭।
  • তর্ক উঠলে আর থামতে চায়না । এ বুঝি জেল খানার এক ব্যাধি। তর্কে তর্কে এমনও হয়েছে কী ছিল তর্কের বিষয় শেষ পর্যন্ত তার্কিকদের সে খেয়ালটাই থাকে না। তর্কের মূল চাপা পড়ে শাখা প্রশাখাই হয়ে ওঠে প্রধান। তর্কেবিতর্কে যে আমার অরুচি এমন নয়, বরং মনে করি এটা মানসিক সজীবতা এবং স্বাস্থ্যেরই লক্ষণ। কিন্তু তর্কটা যখনি ঘোরালো আর উত্তপ্ত কথা কাটা কাটিতে রূপান্তরিত হয় তখনি দমটা আমার বন্ধ হয়ে আসে । আমি পালিয়ে যাই।
    • পৃষ্ঠা ৫১
  • চেঁচিয়ে ডাকলাম কবিকে । তর্কে তর্কে কী হারাচ্ছ কবি, তুমি জান না। এসো এদিকে, তোমার লোহার গরাদে আজ ফুলের আঘাত ।
    • পৃষ্ঠা ৫২
  • ভালো লাগেনা রোজ ঘুম ভেংগে দেখা সেই অপরিবর্তনীয় কয়েকটা মুখ। মুখগুলি যেন মূর্তিমান বিতৃষ্ণা। আর এই বর্ণহীন সাদাটে দেয়ালগুলো, জল্লাদের রক্তচক্ষুর মতো চেয়ে থাকা ওই লাল প্রাচীর, মাথায় যার ছাতা জমেছে, শ্যাওলা পড়েছে কাধে পিঠে এই নিশ্চল পাষাণ প্রহরীদের চেহারা কোন দিনও কি একটু বদলাবেনা, বদলাতে পারেনা? নির্মম রুক্ষ চেহারায় ঘাতকের হুমকি হয়ে চেয়ে থাকে সারাক্ষণ । সেদিকে তাকিয়ে মনে পড়ে যায় অপহৃত আমার স্বাধীনতা, আমি বন্দী। জবরদস্তি করে মনটাকে হেঁচড়ে টেনে বসলাম গিয়ে চেয়ারে । কিন্তু মন কি আর বাঁধন মানে? লেত্তির বাঁধন থেকে ছুটে যাওয়া লাট্টুর মতো ভোঁ ভোঁ করে কোথায় কোথায় ঘুরে চলে।
    • পৃষ্ঠা ৫৩
  • মনে হয় কর্মে আর কোলাহলে চঞ্চল সেই যে এক পৃথিবী, দুরন্ত বেগে যেখানে ছুটে চলেছে জীবনের রথ, সে পৃথিবী যেন বহু দূরের, সে পৃথিবীর কথা ভুলে গেছি আমি।
    • পৃষ্ঠা ৫৪
  • এই যে কোন কিছু ভালো না গালা, অন্তর মাঝে খুঁজে না পাওয়া পৃথিবীর ডাক- একি সেই মৃত্যুরই পূর্বাভাস যার নাম স্থবিরতা? এই যে কোন কিছুই ভালো লাগেনা আমার, পৃথিবীর ডাকখুঁজে পাইনা অন্তরের গভীরে, আমি নির্বিকার, এসব কি সেই স্থবিরতারই লক্ষণ?
    • পৃষ্ঠা ৫৫
  • কিছু নয় বলছিস কালাম? তুই কি বুঝতে পারছিসনা কোথায় চলেছি আমি? কান্না ভুলতে ভুলতে এমনি করে একদিন আমি যে হাসতেও ভুলে যাব! দুঃখ শোক যন্ত্রণা প্রেম প্রীতি ভালোবাসা এ সব মানবীয় অনুভূতিগুলো হারিয়ে আমার কিছু কি আর অবশিষ্ট থাকবে? আমি পাথরে রূপান্তরিত হব । না না কালাম তেমন অমানুষিক অবস্থার কথাটা ভাবতেই পারি না আমি। আমাকে পথ দেখা।
    • পৃষ্ঠা ৫৯।
  • আমি কী? কী সার্থকতা আমার এই মানবজন্মের? আজকের দিনে, এই তারিখে অন্তরের কোন গভীর প্রদেশ আলোড়িত করে এ প্রশ্নটাই যেন উঠে আসে বার বার! এমন প্রশ্ন নিজেকে কি আর কোন দিন শুধিয়েছি? মনে পড়ে না।
    • এগারোই জৈষ্ঠ্য, পৃষ্ঠা ৬৪
  • শুধু আমিই নই, গোটা বাংলা দেশেই যেন হারিয়ে ফেলছে নজরুলকে। ভুলে যাচ্ছে আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবন, ঝঞ্চার বেগে সে এসেছিল, অগ্নিবীণায় সুর তুলেছিল সৃষ্টি প্রলয়ের, নাম পেয়েছিল বিদ্রোহী কবি। বিদ্রোহ তার সনাতনী আচার নীতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, আপন ধর্ম আপন সমাজের অন্ধত্বের বিরুদ্ধে, নপুংসক মেরুদগুহীনদের কাপুরুষতার বিরুদ্ধে। বিদ্রোহ তার পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য, বিদ্রোহ তার অগ্নিময় গদ্যে কবিতার নির্ঘোষে শেকল ভাংগার গানে 'লাংগলের' ভাষায় 'ধুমকেতুর' পাতায় পাতায়। বিদ্রোহ তার ফৌজি ছাউনীতে রণাঙ্গনে, মাঠে প্রান্তরে, রাজপথের মিছিলে, ইংরেজ কারাগারে ভূখ হরতালে । সেই বিদ্রোহী কবিকে যেমন গৌরবে, শ্রদ্ধা প্রীতি ভালোবাসার সম্মানে স্বরণ করা উচিত তেমনি ভাবে স্মরণ করি কী?
  • মাটি নেই পায়ের তলায় অথবা ছিল- সরে গেছে। সরে যাচ্ছে- এ এক মর্মান্তিক উপলব্ধি আমার কাছে। এ উপলব্ধি, এ বোধটুকুর অনেক দাম আমার কাছে। এ উপলব্ধি আমাকে ঘর ছাড়া করেছে, আমি খুঁজতে বেরিয়েছি আমার ভিতরে, আমার মাটিকে । সে মাটির গভীরে আমার শিকড়কে। এই শিকড় খুঁজতে খুঁজতে আমাকে পুনর্বার আবিষ্কার করতে হয় নজরুলকে। কেননা নজরুলকে অনুসরণ করেই তো আমার অস্তিত্বের শিকড় মাটি পেয়েছিল।
  • অসহ্য যন্ত্রণা এই আত্মদর্শন, এই আত্মবিচারে। তেমনি লজ্জা। গাভীর এক লজ্জা। আর ধিক্কার। তবু এই যন্ত্রণাময় অনুভূতি, এই ধিক্কার বোধ আমাকে পাথ দেখায়। আমি খুঁজে পাই, আমার মাটি আর সেই প্রশ্নটির জবাব। আমি কী! আমি সেই কবিসন্তারই একটি অংশ সেই বিদ্রোহী প্রাণেরই ছোট্ট একটি স্ফুলিঙ্গ। এজন্য আমার ও অমরত্বের দাবী, দুর্জয় আবেগে কঠিনের আলিংগন।
    • পৃষ্ঠা ৬৬
  • ওগো মেয়ে! তোমাকেই খুঁজি!
    আকাশ তোরণে
    যেখানে সুর্য্য-প্রদীপ
    সেখানে,
    প্রদীপের ছায়ায় ছম ছম ভয়ে
    সেখানেও ।
    আর এখানে
    এই রুদ্ধ গারদে
    অন্ধ প্রকোষ্ঠে,
    ভ্রকূটির দেয়ালে দেয়ালে ।
    • পৃষ্ঠা ৬৭
  • এই আষাঢ় আকাশ বন্দী হিয়ার রোদন।
    • পৃষ্ঠা ৬৯
  • ত্যাগ তো আমার আনন্দ। ত্যাগের ভেতর দিয়েই আমার সংগাম পরম প্রান্তির। এ-ই তো আমার বিশ্বাস। অটল এই বিশ্বাসের মাঝেও কি রয়েছে এমন কোন ছিদ্রপথ, যে পথ দিয়ে শূন্যতার অনুপ্রবেশ?
    • পৃষ্ঠা ৭১
  • যখন দেখি, কেঁপে কেঁপে যায়
    দূর কোন মশালের ছায়া
    তারা ঝিলিকের মতন,
    তখন মনে হয় তুমি এখানেই ।
    মনে হয়
    তুমি এখানেই,
    গারদের গবাক্ষে
    তুমি এক ছবি অনন্ত আকাশের ।
    শূন্য এই প্রাঙ্গনের প্রাচূর্যে
    আর রিক্ততার ঐশ্বর্যে
    জীবন এক অনন্য প্রত্যাখ্যান,
    কেননা জীবন তো শুধু
    তোমারই অঙ্গীকার ।
    ওগো মেয়ে।
    তাই তো তোমাকে খুঁজি
    • পৃষ্ঠা ৭২
  • এই কারাগারেও শরৎ এসেছে। রুদ্ধ কুঠির বন্ধ অংগনে আজ খলখলিয়ে বেড়ায় সোনারোদ, গরাদ ভেংগে আছড়ে পড়ে সিমেন্টের মেঝেতে । শেফালীরা বিছিয়ে রেখেছে শাদা চার । সকাল বেলার শেফালী তলার ওই শুভ্রতার উপর চোখ রেখে আকাশের সূর্যটাও বুঝি ক্ষণিকের জন্য থমকে দীড়িয়েছে।
    • পৃষ্ঠা ৭৬
  • পুরুষ পরম্পরায় দুশো বছরের যে পরাধীন অভিশপ্ত জীবন, আমি তো তারই ধিক্কৃত সন্তান। আত্মায় চেতনায় আমার যে খণ্ডিত প্রকাশ, আপনার মাঝেই আমি যে দ্বিধাবিভক্ত- এতো উত্তরাধিকার সূত্রে পিতৃঋণের মতোই আমার পাওনা । আর এর বিরুদ্ধেই তো আমার সংগ্রাম। এই অর্থে আমি এক সচেতন সত্ত্বা।
    • পৃষ্ঠা ৭৭
  • মনে মনে বললাম তাই যেন হয়। সেলিমভাই আবার ফিরে যাক আপন নীড়ের আশ্রয়ে । বধুর সেবায় প্রিয়তমার কোমল ছোঁয়ায় আপন জনের প্রীতি মমতায় সেরে উঠুক সেলিম ভাই। ফিরে পাক পবিত্রতার দীপ্তি ছড়ানো আনন্দলেপা সেই মুখশ্রী। সেলিমভাই যেমনটি ছিল আবার তেমনটি হোক। সেলিম ভাই সুন্দর হোক । আনন্দময় হোক।
    • পৃষ্ঠা ৭৯

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা