শিল্পী (নাটক)
শিল্পী নাটকটি লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। নাটকটিতে শিল্পী জীবনের ব্যক্তিজীবন এবং কর্মজীবনের যে সংকট ও দ্বন্দ্ব সেটি মঞ্চে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সংলাপ
সম্পাদনা
লায়লি :
তোমার ছবি আঁকা হল? – (চিত্রকর নীরবে-একমনে ছবি এঁকে চলেছে) – ওগো শুনছ?
চিত্রকর :
(চমকে উঠে) অ্যাঁ! আমায় ডাকছিলে লায়লি?
(লায়লি অভিমানে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে চোখের জল গোপন করল। চিত্রকর আবার একমনে চিত্র আঁকতে লাগল।)
লায়লি :
দোহাই! তুমি অন্য ঘরে ছবি আঁক গিয়ে! আমার বড্ড বিশ্রী লাগছে! (শেষের কথা কয়টা বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল)
(চিত্রকরের হাত হতে তুলি পড়ে গেল – লায়লির কান্না-দীর্ণ স্বরের তীব্রতায়)
চিত্রকর :
(সবিস্ময়ে) লায়লি! তুমি কাঁদছ?
লায়লি :
(তীব্রস্বরে) না! রহস্য করছি! তুমি একটু অন্য ঘরে উঠে যাবে? দয়া করে আমায় একটু একলা থাকতে দাও!
চিত্রকর :
(উদাসীনভাবে) আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। তোমার রোগ-যন্ত্রণা আর বাড়াতে চাইনে তোমার কাছে থেকে। (চলে যাওয়ার উপক্রম করল।)
লায়লি :
যেয়ো না। দুটো কথা আছে, শুনে যাও।
চিত্রকর :
(বসে পড়ে) বলো।
লায়লি :
ওখানে না। আমার পাশে এসো বসো।
চিত্রকর :
(লায়লির পাশে বসে) বলো। (আনমনে লায়লির কপোল ও ললাট হতে অলকগুচ্ছ তুলে দিতে লাগল।)
লায়লি :
সত্যি করে বলো দেখি, তুমি বিয়ে করেছিলে কেন?
চিত্রকর :
বিয়ে করার জন্যই।
............
(বাহিরের শব্দ।) আমি তোমার বন্ধু।
লায়লি :
(চিৎকার করে) খুলো না! দোর খুলো না! আমি চিনেছি, ও কে। ও ডাইনি, ও চিত্রা।
চিত্রকর :
ছিঃ লায়লি! তুমি শিক্ষিতা সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে, এ কী ব্যবহার তোমার?
চিত্রা (বাহির হতে) :
আমি ভিতরে যাব না বন্ধু, তুমি বেরিয়ে এসো।
লায়লি :
যাও! তোমার বাইরের ডাক এসেছে। তোমার সুন্দরের ধ্যান আমি ভাঙব না। আমায় ক্ষমা করো। আমি যেদিন থাকব না ওই চিত্রার মাঝেই আমাকে স্মরণ করো।
[চিত্রকর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল। ঘরের প্রদীপও সাথে সাথে নিভে গেল।]
............
চিত্রা :
তুমি এমন করে বল বলেই তো তোমায় কাছে – আরও কাছে পেতে ইচ্ছে করে – যেমন করে আমার নোটন-পায়রাগুলিকে বুকে জড়িয়ে চুমু খাই তেমনই করে। আমিও তোমায় শাপভ্রষ্ট দেবকুমার শিল্পী বলেই জানতাম। তাই তোমার কাছে এসেছিলাম শ্রদ্ধার পূজাঞ্জলি নিয়ে। তুমি মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখলে। আমার রূপের প্রশংসা শুনতে শুনতে আমার বিরক্তি ধরে গেছে, তবু ওই চাওয়া দেখে মনে হল, আমার এত রূপ সার্থক হল এতদিনে। মনে হল, এত রূপ ধরবার মতো শুধু এই দুটি চোখই আছে পৃথিবীতে। তোমার স্তব-গানে আমার হৃদয় শতদলের মতো বিকশিত হয়ে উঠল! (দীর্ঘশ্বাস মোচন করে) হায় উদাসীন! তুমি আমায় বুঝবে না। তুমি বিকশিত শতদলের শোভা দেখ শুধু, বেদনায় শতদল বিকশিত হয়ে ওঠে সে বেদনার কী বুঝবে তুমি?
চিত্রকর :
সত্যি চিত্রা, শিল্পী চাঁদ পাখি – এরা আর সব বোঝে, শুধু বোঝে না বেদনা।
চিত্রা :
তুমি পাষাণ অ্যাপোলো। তবু জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, সত্যি তোমার মনে আর কোনো লোভ নেই? যে ফুল কাননে ফোটে, তাকে কাননেই ঝরতে দিতে চাও, মালা করে গলায় পরাতে ইচ্ছা করে না?
চিত্রকর :
না বন্ধু, ফুলের সুবাসই আমার পক্ষে যথেষ্ট, তাঁকে গলায় জড়িয়ে ফাঁসি পরবার সাধ আমার নহে।
চিত্রা :
আমি অন্যের হলে তোমার দুঃখ হবে না?
চিত্রকর :
হবে। সে দুঃখ আমার জন্য নয়, তোমার জন্য। সুন্দর ফুল এমনি ঝরে পড়ে তা সওয়া যায়, কিন্তু তাকে জোর করে বৃন্তচ্যুত করে কাঁটা বিঁধে মালা করতে দেখলে আমার কষ্ট হয়।
চিত্রা :
(দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্লান স্বরে) ও-ব্যথা তো সকলের জন্যে। একা-আমার জন্য তোমার কোনো ব্যথাই নেই?
চিত্রকর :
(আকুল স্বরে) না চিত্রা। আমি শিল্পী, হৃদয়হীন নির্বেদ উদাসীন শিল্পী!
চিত্রা :
(সজল কণ্ঠে) তা হলে আমি যাই?
চিত্রকর :
(শান্ত স্বরে) যাও।
চিত্রা :
তোমার একটা কিছু দেবে আমায় – তোমায় মনে রাখবার মতো কিছু?
চিত্রকর :
(তার তুলি নিয়ে) এই নাও।
চিত্রা :
এ কী? তুলি? তুমি আর ছবি আঁকবে না?
চিত্রকর :
(সাশ্রুনেত্রে) না চিত্রা! আমার এই তুলি বহু হৃদয়ের রক্তে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে, আর পারি না!
চিত্রা :
(সবিস্ময়ে) এ কী শিল্পী?
চিত্রকর :
এই সত্যি চিত্রা! জীবনে এই প্রথম অশ্রু এল আমার চোখে। যেই তুমি চলে যেতে চাইলে, অমনি কেন আমার এই প্রথম মনে হল, এমন সুন্দর বিশ্ব কে যেন তার স্থূল হস্ত দিয়ে মুছে ফেলছে! – আমি চললাম চিত্রা!
চিত্রা :
(হাত ধরে) কোথায় যাবে বন্ধু?
চিত্রকর :
(ধীরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সেই হাতে চুম্বন করে) যে-পথে পৃথিবীর কোটি কোটি ধূলিলিপ্ত সন্তান নিত্যকাল ধরে চলেছে, সেই দুঃখের, সেই চিরবেদনার পথে। (প্রস্থান)
চরিত্র
সম্পাদনা
লায়লি
চিত্রকর
চিত্রা