সৈয়দ হাসান ইমাম

বাংলাদেশি অভিনেতা ও আবৃত্তিকার

সৈয়দ হাসান ইমাম (জন্ম: ২৭ জুলাই, ১৯৩৫ বর্ধমান, ভারত) বাংলাদেশের একজন অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, টেলিভিশন পরিচালক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি একুশে পদক, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার এবং আজীবন সম্মানের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অংশ ছিলেন।

  • আবৃত্তিশিল্পী ও অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে আমি সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। এ বয়সে পুরোপুরি ভালো থাকা না গেলেও যতটুকু সুস্থ আছি ভালোই আছি। সুস্থতার জন্য মোটামুটি নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করি। আমি আমার জীবনটা উপভোগ করেছি। নানা সংগ্রাম ও সংকটের মধ্যেও জীবনকে উপভোগ করে গেছি। আবার জন্ম নিলে আমি এই জীবনই চাইতাম।
  • সত্যি কথা বলতে জীবন অনেক সুন্দর। বেঁচে থাকাটা আরও সুন্দর। বেঁচে থাকার চেয়ে সুন্দর আর কিছু হতে পারে না। দেখুন, একটা বিচিত্র জীবন আমি কাটালাম। বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে এখনো বেঁচে আছি। জীবন নিয়ে ধারণা হচ্ছে— মানুষের বয়স বাড়ে, মানুষ বুড়ো হয়, কিন্তু, মন কখনো বুড়ো হয় না। মন চির যৌবনে থেকে যায়।

এদেশে যত মহামারি-দুর্যোগ এসেছে, সব সময়ই মাঠে গিয়ে কাজ করেছি। এখন তো বয়সের কারণে চাইলেও পারব না। তারপরও ঘরে বসে কাছের ও চেনা মানুষদের মধ্যে যারা অসচ্ছল, তাদের সহযোগিতা করতে পারছি। এটাও কম কী।

কোনো পেশা নয়, নিজেকে সব সময় একজন মানুষ মনে করি। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। জীবন মানে কেবল নিজের জন্য নয়, সব মানুষের হয়ে থাকার নামই জীবন।

  • আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই। নিজের বিবেক যা বলেছে তা করেছি। সব সময় সততা নিয়ে কাজ করেছি। মানুষ আমাকে এত কিছু দিয়েছেন যে আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই।
  • আসলে রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী যখন করি তখন অসংখ্য মানুষ এসেছিলেন। তারা নিজেদের তার সাথে যুক্ত করেছেন। তারা মনে করেছেন রাজার পতন মানে আইয়ুব খানের পতন। সংস্কৃতির এই তো গুণ। সংস্কৃতি কবর থেকে উঠে এসে আধুনিক হয়ে যায়।রবীন্দ্রনাথকে আমরা ব্যবহার করেছি আমাদের আন্দোলনে। মুক্তিযুদ্ধেও আমরা ব্যবহার করেছি। নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ দাশের -এর লেখাও এভাবে আমরা ব্যবহার করেছি।
    • ১৯৬১ সালে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষের আয়োজন প্রসঙ্গে
  • মুক্তিযুদ্ধ অনেক বড় বিষয়। যে কারণে এই বিষয়ে অনেক সিনেমা নির্মাণ হয়েছে এবং আগামীতে হবে। কিন্তু কোনো আন্দোলন নিয়ে আমাদের সিনেমা নির্মিত হয়নি। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন নিয়ে সিনেমা হয়নি, আসাদকে নিয়ে সিনেমা হয়নি। এগুলো নিয়ে অবশ্যই সিনেমা হওয়া উচিত।
  • একজন শিল্পীর মৌলিক গুণ হচ্ছে- ভালো মানুষ হওয়া, সৎ থাকা, মানুষসহ সব সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা থাকা।
  • নায়কেরা যদি দূর গ্রহের অচিন মানুষ হয়, তবে সে নায়ক আমি না। দর্শকেরা নায়ক হিসেবে না চাইলে নায়ক হব না।
  • পাক হানাদাররা আগে থেকেই বাঙালি তরুণদের ওপর নজর রাখছিলেন। তাই অনেকের কাছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করাটা জটিল হয়ে পড়েছিল। অনেককে ঝুঁকি নিয়ে ভারতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। তবে আমরা ২৫ মার্চের আগেই পাক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলছিলাম। `৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে আহ্বায়ক করে শিল্পীদের প্রতিবাদী সংগঠন ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ গঠিত হয়েছিল। আমারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বর্জন করি। গণআন্দোলনের চাপে পাকিস্তান সরকার ৮ মার্চ থেকে বেতার-টেলিভিশনের দায়িত্ব বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চের পর আমি মুজিব নগরে চলে যাই। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাট্য বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করি।
  • ৭ মার্চের দিনটির কথা কোনোভাবেই ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়, এটা শুধু উপলব্ধি করা যায়। তবে সেদিন বাঙালির মুক্তি চেতনা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম, স্বাধীনতা আমাদের জন্য অনিবার্য। বাস্তবে তাই ঘটেছে।
  • বাংলাদেশের দর্শক হিসেবে আমার হীনম্মন্যতার কোনো সুযোগ নেই। ভালো কাজ হচ্ছে। আমাদের কেবল সেটা গ্রহণ করতে হবে। সেটা যদি দর্শক করে ফেলে, তাহলে নিয়মিত পাল্লা দিয়ে ভালো কাজ হবে। বিদেশি জিনিসপত্রের দিকে না তাকিয়ে আমাদের শুধু নিজেদের কাজের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। ভুলবেন না, আপনার মা যদি বড় পর্দার নায়িকার মতো সুন্দরী না-ও হয়, তা–ও সে আপনার মা।
  • খেলাটাকে প্রথম দিকে পেশা হিসেবে নেব ভেবেছিলাম। কিন্তু আরামবাগ নামে একটা জায়গায় খেলতে গেছিলাম। সেখানে বিহার কাঠিয়ার পুলিশের সঙ্গে খেলা ছিল। আমি একটা হাফভলি নিতে গেছি গোলের সামনে থেকে, পাশ থেকে আমাকে চার্জ করল। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। ডান পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেল। সে সময় তো অপারেশন ভালো ছিল না। ডাক্তার বললেন, অপারেশন করলে পা বেঁকে যেতে পারে। ডাক্তার বললেন, তুই ফুটবল খেলা ছেড়ে দে। রাতে খুব কাঁদলাম। এরপর ফুটবল খেলা ছেড়ে দিলাম। ঢাকায় এসে ক্রিকেটও ছেড়ে দিলাম।
  • স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অসাধারণ অবদান, সেসময় অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তারা স্বাধীনতার চেতনায় স্থির থেকেছে এবং তারা বিশ্বাস করেছে যে আমরা জয়ী হব। নিজেদের ছেলেদের সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে।
    • স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকার কথা স্মরণে বিডিনিউজ
  • মানুষের ভয় কাটিয়ে দিয়েছে যে, ইয়াহিয়া খানকেও জয় করা যায়। যে আতঙ্ক ছিল সেই আতঙ্ককে কাটিয়ে দিয়ে তাদেরকে ছোট করে দেওয়া। এটা একটা ক্ষুদ্র জিনিস.. ইয়াহিয়া খানকে পরাজিত করা কোনো ব্যাপার না।
  • বঙ্গবন্ধুর অনেক কথার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ হলো—“আমি কমিউনিস্ট নই কিন্তু আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি।’ সমাজতন্ত্র আর কমিউনিজম কিন্তু এক নয়। কমিউনিজমে ধর্মকে আফিম বলা হয় কিন্তু একজন ধর্মপালনকারীও সমাজতন্ত্রী হতে পারেন এবং বঙ্গবন্ধু তা-ই ছিলেন। তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। এখানে একটা জিনিস আমরা দেখি যে, আমাদের সবচেয়ে দুর্ভাগ্য—আমরা যখন স্বাধীন হলাম তারপরেই কিন্তু পৃথিবীর প্রেক্ষাপট বদলে গেল। আমাদের অক্ষে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল এবং যার জন্য আমরা সমাজতন্ত্রের কথা বলতে শিখেছিলাম। সেই দেশটি আর সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার ফলে তাদের যে আন্তর্জাতিকতাবাদ ছিল তা আর থাকল না; জাতীয়তাবাদী রাশিয়া হয়ে গেল। এর ফলে আমরা একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হারালাম।
  • আমাদের সম্ভাবনা হলো নতুন প্রজন্ম। নতুন প্রজন্ম খুবই প্রতিভাবান। তারা অনেক বেশি পৃথিবীকে দেখতে পাচ্ছে সহজে; হাতের মুঠোর মধ্যে দেখতে পাচ্ছে। আমি শুধু তাদেরকে বলব তোমাদের দৃষ্টিটা পশ্চিমের দিকে না রেখে দেশের দিকে তাকাও, দেশের মানুষকে জানো। আমরা যতটা ইউরোপ-আমেরিকাকে জানি ততটা আমাদের গ্রামকে জানি না। যারা প্রশাসনের বড় বড় জায়গায় বসে আছেন, যারা দেশ চালাচ্ছেন তাদের অনেকের সাথেই এখন আর গ্রামের তেমন যোগাযোগ নেই এবং দেশটাকে অতটা জানেন না। দেশটাকে জানতে হবে, দেশের মানুষকে জানতে হবে এবং তাদেরকে ভালোবাসতে হবে। রাজনীতি আর শিল্পের সমন্বয় করে মানুষের কাছে উপস্থাপন করলেই তো একটা সুন্দর সংস্কৃতি গড়ে ওঠে যা মাটির সংস্কৃতি।

সৈয়দ হাসান ইমামকে নিয়ে উক্তি

সম্পাদনা
  • একজন মানুষ যিনি রাজনৈতিক দীক্ষার সঙ্গে সাংস্কৃতিক প্রেরণাকে যুক্ত করেছিলেন। আমাদের প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধারা সৈয়দ হাসান ইমামের প্রতি কৃতজ্ঞ।

তার প্রেরণা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদান রেখেছিল। গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে সৈয়দ হাসান ইমামের অবদান বাদ দিয়ে এ দেশের নাটকের ইতিহাস লেখা যাবে না। তাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

  • তিনি যেটাকে আদর্শ মনে করেন তা তিনি যে কোনোভাবে পালন করেন। এটা তার চরিত্রের অত্যন্ত দৃঢ়তর একটি দিক।
  • তার জীবন আমাদের কাছে শিক্ষণীয় ও প্রেরণার উৎস। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতে যে কজন বিরলপ্রজ মানুষ রয়েছেন তাদের মধ্যে হাসান ইমাম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
  • বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। কোনো কোনো মানুষ স্বার্থের জন্য খোলস পাল্টায়।

কিন্তু হাসান ইমাম কখনই স্বার্থের জন্য তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তার জীবন একজন নিষ্ঠাবান সৎ আদর্শবান সচেতন সংস্কৃতিবান মানুষের ‘প্রতীক।

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা