অসহযোগ আন্দোলন (১৯৭১)

১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক-মুক্তিযুদ্ধ আন্দোলন

অসহযোগ আন্দোলন ১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগপূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ কর্তৃক পরিচালিত একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন। ১ মার্চে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণার পর জনগণের স্বতস্ফুর্ত আন্দোলন শুরু হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ২ মার্চে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলমান থাকে। মোট ২৫ দিন স্থায়ী হয় এই আন্দোলন। আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। এই সময়কালে ক্রমশ পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের উপর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রায় অচল হয়ে পড়ে। আন্দোলনের একপর্যায়ে সেনানিবাসের বাইরে পুরো পূর্ব পাকিস্তান কার্যত শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে চলছিল।

বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া ছিল কতটা সর্বাত্মক, টেলিভিশনের এ ঘটনা তার সাক্ষ্য হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে এ ভূখণ্ড ক্যান্টনমেন্টের নির্দেশে নয়- পরিচালিত হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর। তিনি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন।
  • বাঙালি-বাংলাদেশের ইতিহাস একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দিগ্​দর্শন। বাঙালির অতিজাগরণে অসহযোগ আন্দোলন এবং পরবর্তী পর্যায়ে যোদ্ধা জাতি হিসেবে বাংলাদেশের সৃষ্টি বাঙালির এক দীপ্ত নতুন পরিচয়।
  • মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে যাঁরা রাজপথে অবস্থান করছিলেন, তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন না। তাতে ডান-বাম–মধ্যপন্থার সব শ্রেণির মানুষ ছিলেন, নির্দলীয় মানুষ তো ছিলেনই। ছিলেন কবি-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী, কট্টর কমিউনিস্ট যেমন ছিলেন, আলেম-উলামারাও ছিলেন। তাঁদের অবদান অস্বীকার করা হবে অকৃতজ্ঞতা শুধু নয়, ইতিহাসকে অস্বীকার। সব দল-মত ও শ্রেণি-পেশার সমর্থন ও অংশগ্রহণের ফলেই মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধে পরিণত হতে পারে।
  • পৃথিবীর আর কোনো দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেই সংশ্লিষ্ট দেশটির জাতীয় স্বাধীনতা স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত প্রশাসনকে এভাবে তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করতে দেখা যায়নি। এর একটি প্রধান কারণ, বঙ্গবন্ধু আহূত অসহযোগ আন্দোলন এমনই ব্যাপক ও সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাপার হয়ে পড়েছিল যে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সচল রাখার প্রয়োজনে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই বঙ্গবন্ধুকে সারাদেশের শাসনভার পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়। আমাদের দেশে স্বাধীনতার ঘোষণার দিনক্ষণ নিয়ে যে বিতর্ক চলে তা একান্তই অবান্তর।
  • ...অসহযোগ আন্দোলন পুরোপুরিই সফল হয়। তবে এই সাফল্য বাংলাদেশের ভেতরে ন্যূনতম জন ও অর্থনৈতিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি করে। সে সময় সারা বাংলাদেশের শ্রমিক সমাজ, জনপ্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দেয়। সেনাছাউনিগুলোর বাইরে আর কোথাও পাকিস্তান সরকারের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়নি। এই শূন্যতার কারণে দেশের সামাজিক জীবন ভেঙে পড়তে পারত। ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ ইয়াহিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের সেনাছাউনিতে ফিরে যাওয়ার হুকুম দেওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর সেদিনই প্রথম বাংলাদেশ তার ‘স্বশাসন জারি’ করতে সক্ষম হলো।
    • রেহমান সোবহান, ‘সাক্ষাৎকার’, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র’ : পঞ্চদশ খ-, ১৯৮৫, পৃষ্ঠা-৩৮৬।
  • আমরা নিশ্চয়ই শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে চাই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, যে কোনো আক্রমণ আমরা সহ্য করব। গত ২২ দিনের অসহযোগ আন্দোলনে ক্ষমতাসীন চক্রের মাজা ভেঙে দিয়েছি। অধিকার যে আমাদের প্রতিষ্ঠিত হবে, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। ... কোনো শক্তিই আমাদের চূড়ান্ত বিজয় ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
  • ...সমগ্র পূর্ব বাংলা জুড়ে অসহযোগ আন্দোলনকে তীব্রতর করা হয়। এই আন্দোলনের খবর ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সব সংবাদপত্রে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হচ্ছিল এবং তার ফলে প্রদেশব্যাপী শহরে, নগরে, বন্দরে অপ্রতিহত গতিতে আন্দোলনটি ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বেতার থেকেও কিছু কিছু খবর প্রচার করা হচ্ছিল। টেলিভিশন বা মোবাইল ফোনের প্রচলন তখনও হয়নি। রেডিও পাওয়া গেলেও গ্রাম/শহরের বাড়ি বাড়িতে দূরের কথা, পাড়ায় একটি করেও ছিল না। সংবাদপত্র ও মফস্বলে গিয়ে পৌঁছাত একদিন পরে।

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা