কাহ্নপা

চর্যাগীতির পদকর্তা

কাহ্নপা (আনু. ১০ম শতক) বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য ও চর্যাপদকর্তা। প্রকৃত নাম কৃষ্ণাচার্য পাদ, অপভ্রংশে হয়েছে কাহ্নপা, কনহপা, কাহ্নিল পা ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্যের আদি নির্দশন চর্যাপদের কবিগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক ১৩টি পদের রচয়িতা। পালরাজবংশের তৃতীয় রাজা দেবপালের রাজত্বকালে (আনু. ৯০০-৫০) তিনি বর্তমান ছিলেন।[] তিব্বতী ঐতিহ্যানুসারে, ব্রাহ্মণ বংশজাত নাথপন্থী ও পরে সহজিয়া মতে দীক্ষাপ্রাপ্ত আচার্য কৃষ্ণপাদ বা কাহ্ন পা বৌদ্ধ মহাসিদ্ধ জলন্ধরীপাদের শিষ্য ছিলেন। সহজপন্থী তান্ত্রিক কাহ্ন পা সিদ্ধাচার্য, মন্ডলাচার্য ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত হন। তিব্বতী বৌদ্ধ লামা তারানাথের মতে, বিদ্যানগর নামক স্থানে তাঁর বাসস্থান ছিল। সম্প্রতি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গবেষক প্রখ্যাত বৌদ্ধ ধর্মীয় অধ্যক্ষ জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া “নেত্রকোণা: অতীত ও বর্তমান” শীর্ষক এক গবেষণামূলক রচনায় ভাষাবিচারে কাহ্নপাকে বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলার কৃষ্ঠপুর গ্রামের সন্তান বলে দাবী করেছেন। কাহ্নপা সোমপুর মহাবিহারে সাধনা করতেন। তিনি হেবজ্র, যমান্তক প্রভৃতি বজ্রযান তন্ত্রসাধনার ওপর পঞ্চাশটির ওপর গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি চর্যাপদের তেরোটি পদ রচনা করেন। তবে কাহ্নপা রচিত ২৪তম পদটি পাওয়া যায়নি।[] অন্যান্য পদকর্তার মতো কাহ্নপাও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তাঁর প্রত্যেক পদের শীর্ষে রাগ-তালের উল্লেখ আছে। রূপক-প্রতীক-সংকেতের ভাষায় রচিত পদগুলিতে তাঁর কবিত্বশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর নামে প্রচলিত কয়েকটি গ্রন্থ হচ্ছে: কাহ্নপাদগীতিকা, শ্রীহেবজ্রপঞ্জিকা যোগরত্নমালা, হেবজ্রসাধন তত্ত্বোদ্যোৎকর, হেবজ্রপদ্ধতি মন্ডলবিধি ইত্যাদি।[]

কাহ্নপা
  • চর্যা:৭
আলিএ কালিএ বাট রুন্ধেলা ।

অন্তর্নিহিত ভাব:-

আলি-কালি অর্থ' যথাক্রমে লোকজ্ঞান ও লোকভাস। রজ্জুতে সর্পভ্রমের ন্যায় এই জগৎ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে লোকভাস। লোকজ্ঞানকে এখানে লোক বাসের সঙ্গে অভিন্নরূপে গ্রহন করা হয়েছে; ভ্রান্তিবশতঃ এই লোকজ্ঞান ও লোকভাসকেই প্রকৃতরূপে গ্রহন করাতে নির্বাণলাভের পথ অবরুদ্ধ হয়।

    • চর্যাগীতিকা। মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা (সম্পাদিত)। স্টুডেন্ট ওয়েজ, অষ্টম সংস্করণ। পৃষ্ঠা ৭৭।
  • চর্যা:৭
জো মণ গোঅর সো উআস ॥ ধ্রু ॥

নিহিতার্থ:-

যে এই জগতের মায়াকে চেনে তাকে জানে সে(জাগতিক মোহ সম্বন্ধে) উদাস।

    • চর্যাগীতিকা। মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা (সম্পাদিত)। স্টুডেন্ট ওয়েজ, অষ্টম সংস্করণ। পৃষ্ঠা ৭৭।
  • চর্যা:৭
জে জে আইলা তে তে গেলা ।

অবণাগবণে কাহ্ন নিঅড়ি বিমণা ভইলা' ॥ ধ্রু ॥ নিহিতার্থ:-

জগতে যা কিছু উৎপন্ন হয়, তা বিনাশ লাভ করে_এ দেখে কাহ্নপা দুঃখিত হয়ে মুক্তির পথ সন্ধান করছেন।

    • চর্যাগীতিকা। মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা (সম্পাদিত)। স্টুডেন্ট ওয়েজ, অষ্টম সংস্করণ। পৃষ্ঠা ৭৭।
  • চর্যা:৯
জিন জিম করিআ করিণিরে রিসই ।
তিম তিম তথতা মঅগল বরিসই ॥ ধ্রু ॥

অন্তর্নিহিত ভাব:-

হস্তী যেমন হস্তিনীর প্রতি আসক্ত হয়, তেমনি খাদে পতিত হস্তী অর্থাৎ সংসারের মায়ায় আবদ্ধ মানব জগতের প্রতি তাঁর আকর্ষণরূপ মদ্য বর্ষণ করে।

    • চর্যাগীতিকা। মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা (সম্পাদিত)। স্টুডেন্ট ওয়েজ, অষ্টম সংস্করণ। পৃষ্ঠা ৮২।
  • চর্যা:৯
ছড়গই সঅল সহাবে সূধ ।
ভাবাভাব বলাগ ন ছুধ ॥ ধ্রু ॥

নিহিতার্থ:-

জীব সকল স্বভাবতই শুদ্ধ, সকলেই ধর্মকায় হতে উদ্ভূত। কেবল অবিদ্যা-জনিত প্রবৃত্তি থেকেই মানুষ বস্তুস্বরূপ বিস্মৃত হয়।

    • চর্যাগীতিকা। মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা (সম্পাদিত)। স্টুডেন্ট ওয়েজ, অষ্টম সংস্করণ। পৃষ্ঠা ৮২।
  • চর্যা:১১
রাগ দেশ মোহ লইআ ছার‌ ।
পরম মোখ লভই মুত্তিহার ॥ ধ্রু ॥

নিহিতার্থ:-

রাগ-দ্বেষ-মোহকে ভস্মীভূত করলেই লাভ হয় পরমমোক্ষের মুক্তাহার।

    • চর্যাগীতিকা। মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা (সম্পাদিত)। স্টুডেন্ট ওয়েজ, অষ্টম সংস্করণ। পৃষ্ঠা ৮৯।

কাহ্নপা সম্পর্কে উক্তি

সম্পাদনা
  • চর্যাপদের কবিগণের মধ্যে সর্বাধিক পদ রচনার গৌরব অর্জন করেছেন চর্যাকার কাহ্ন পা। তার তেরটি পদ চর্যাপদে ঠাঁই পেয়েছে। এই সংখ্যাধিক্যের দরুন তাকে ‘শ্রেষ্ঠ চর্যাকার’ বলে অভিহিত করা হয়।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়

কাজী নজরুল ইসলাম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

লিও তলস্তয়

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা
  1. "কাহ্নপা"। বাংলাপিডিয়া। ২০১৪-০৫-০৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৪-২৩।
  2. "কাহ্নপাদ"। উইকিপিডিয়া। ২০২৪-০৩-০৫।
  3. "Roar বাংলা - চর্যাপদের কবিগণ"। archive.roar.media। ২০২২-০৭-০২। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৪-২৩।