প্যারীচাঁদ মিত্র
ভারতীয় বাঙালি লেখক
প্যারীচাঁদ মিত্র (২২ জুলাই ১৮১৪- ২৩ নভেম্বর ১৮৮৩) ছিলেন একজন লেখক, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবী এবং ব্যবসায়ী। বাংলা সাহিত্যে তিনি টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে লিখতেন। কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান হিসেবে ১৮৩৬ সালে প্যারীচাঁদ মিত্রের কর্মজীবন শুরু হয়। তিনি দি ইংলিশম্যান, ইন্ডিয়ান ফিল্ড, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া, বেঙ্গল স্পেক্টেটর প্রভৃতি পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। প্যারীচাঁদের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো আলালের ঘরের দুলাল, মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়, রামারঞ্জিকা, কৃষিপাঠ, ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিত, বামাতোষিণী প্রভৃতি। তিনি বেশ কয়েকটি ইংরেজি গ্রন্থও রচনা করেছেন। সাহিত্যক্ষেত্রে প্যারীচাঁদের সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব আলালের ঘরের দুলাল উপন্যসটি। এই উপন্যসটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবে খ্যাত।
উক্তি
সম্পাদনা- নৌকা দেখিতে২ ভাঁটার জোরে বাগবাজারের ঘাটে আসিয়া ভিড়িল। রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে—কলুরা ঘানি জুড়ে দিয়েছে—বল্দেরা গোরু লইয়া চলিয়াছে—ধোবার গাধা থপাস২ করিয়া যাইতেছে—মাছের ও তরকারির বাজরা হু২ করিয়া আসিতেছে—ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কোশা লইয়া স্নান করিতে চলিয়াছেন—মেয়েরা ঘাটে সারি২ হইয়া পরস্পর মনের কথাবার্ত্তা কহিতেছে।
- আলালের ঘরের দুলাল - প্যারীচাঁদ মিত্র, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ (১২৭৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৯
- বাহ্য আড়ম্বরীয় শিক্ষাতে সমাজ সুশোভন হইতে পারে; কিন্তু ঈশ্বর পরায়ণত্বের ব্যাঘাত, আত্মবলের হ্রাস ও প্রকৃতির প্রাবল্য। ঈশ্বর পরায়ণত্ব ও আত্মবলের জন্য এদেশের মহিলাগণ পূর্ব্ব হইতেই বিখ্যাত। কোন দেশে পতির জন্য স্ত্রীলোক অগ্নিতে গমন করে? ও সর্ব্বত্যাগী হইয়া, ব্রহ্মচর্য্য অনুষ্ঠান করে? সামাজিক বিবেচনায় ইহা যদিও প্রসিদ্ধ না হইতে পারে, কিন্তু আত্মবলের পক্ষে ইহা বিলক্ষণ প্রমাণ।
- এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্ব্বাবস্থা - প্যারীচাঁদ মিত্র, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ (১২৮৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪৭
- যে মানুষ মদ খায় সে আমোদের জন্য খায়, মদ বন্ধ করিতে গেলে যাহাতে তাহার আমোদ হইয়া মদকে ভোলে এমত তদ্বির করা উচিত নতুবা তাহাকে কেবল টাঙ্গিয়া রাখিলে প্রকাশ্য ভাবে হউক বা গুপ্ত ভাবে হউক পুনরায় মদ ধরিবে।
- মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায় - প্যারীচাঁদ মিত্র, দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রকাশসাল- ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ (১২৬৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১১
- গার্হস্থাশ্রম ও যোগ আশ্রম পৃথক। যাহারা চরম আশ্রম অবলম্বন করিয়া ব্রহ্মলাভ করিতে চাহে, তাহারা অবশ্যই সর্ব্ব সঙ্গ ত্যাগ করিয়া ঈশ্বরের সঙ্গ করিবে ও ঐ লাভার্থে গৃহ ও সামাজিক বন্ধন হইতে ক্রমশঃ অবশ্য মুক্ত হইবে।
- আধ্যাত্বিকা, লুপ্তরত্নোদ্ধার (প্যারীচাঁদ মিত্রের গ্রন্থাবলী), প্রকাশক- হিতবাদী কার্ধ্যালয়, প্রকাশসাল- ১৩২০ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ১১
- সেগুনের ফল অতিশয় শক্ত, তাহার মধ্যে চারিটা করিয়া গহ্বর আছে, প্রত্যেকে এক একটা বীজ থাকে। সেই বীজ ভূমির মধ্যে বপন করিলে ১৮ মাস পর্য্যন্ত তাহা হইতে গাছ উৎপন্ন হইতে পারে।
- কৃষিপাঠ, লুপ্তরত্নোদ্ধার (প্যারীচাঁদ মিত্রের গ্রন্থাবলী), প্রকাশক- হিতবাদী কার্ধ্যালয়, প্রকাশসাল- ১৩২০ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ২
- মদের অদ্ভুত শক্তি! যে ব্যক্তি পান করে সে দুধকে জল বলে ও জলকে দুধ বলে। কলিকাতার কোন বুনিয়াদি মাতালের বাটীতে তাঁহার চাকর প্রস্রাব করিতেছিল, মাতাল বাবুর মস্তকে পড়িলে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন আমার মাথায় কি পড়িল? পরে শুনিলেন― প্রস্রাব। তখন আপনি কহিলেন তবে ভাল, আমি বোধ করিয়াছিলাম—জল।
- মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায় - প্যারীচাঁদ মিত্র, দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রকাশসাল- ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ (১২৬৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২
- একদিন সন্ধ্যার সময় বৈদ্যবাটীর নিকট দিয়া একখানা জানানা সোয়ারি যাইতেছিল। নববাবুরা ঐ সোয়ারি দেখিবামাত্র দৌড়ে গিয়ে চারিদিক ঘেরিয়া ফেলিল ও বেহারাদিগের উপর মারপিট আরম্ভ করিল, তাহাতে বেহারারা পাল্কি ফেলিয়া প্রাণভয়ে অন্তরে গেল। বাবুরা পাল্কি খুলিয়া দেখিল একটি পরমা সুন্দরী কন্যা তাহার ভিতরে অছেন— মতিলাল তেড়ে গিয়া কন্যার হাত ধরিয়া পাল্কি থেকে টানিয়া বাহির করিয়া আনিল।
- আলালের ঘরের দুলাল - প্যারীচাঁদ মিত্র, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ (১২৭৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৬২-৬৩
- ঋগ্বেদের সময় সহমরণ ছিল না। যিনি বিধবা হইতেন, তিনি স্বামীর মৃতদেহের সহিত কিয়ৎকালের জন্য স্থাপিত হইয়া উঠিয়া আসিতেন। পরে তিনি অন্য পুরুষকে বিবাহ করিতে পারিতেন। ঋষিরা বিধবা বিবাহ করিতেন।
- পুনর্ব্বিবাহ, সহমরণ ও ব্রহ্মচর্য্য, এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্ব্বাবস্থা- প্যারীচাঁদ মিত্র, প্রকাশসাল- ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ (১২৮৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩১
প্যারীচাঁদ মিত্রকে নিয়ে উক্তি
সম্পাদনা- প্যারীচাঁদ মিত্র আদর্শ বাঙ্গালা গদোর সৃষ্টিকর্ত্তা নহেন, কিন্তু বাঙ্গালা গদ্য যে উন্নতির পথে যাইতেছে, প্যারীচাঁদ মিত্র তাহার প্রধান ও প্রথম কারণ। ইহাই তাঁহার অক্ষয় কীর্ত্তি। আর তাঁহার দ্বিতীয় অক্ষয় কীর্ত্তি এই যে, তিনিই প্রথম দেখাইলেন যে, সাহিত্যের প্রকৃত উপাদান আমাদের ঘরেই আছে, তাহার জন্য ইংরাজি বা সংস্কৃতের কাছে ভিক্ষা চাহিতে হয় না। তিনিই প্রথম দেখাইলেন যে, যেমন জীবনে তেমনই সাহিত্যে, ঘরের সামগ্রী যত সুন্দর পরের সামগ্রী তত সুন্দর বোধ হয় না। তিনিই প্রথম দেখাইলেন যে, যদি সাহিত্যের দ্বারা বাঙ্গালা দেশকে উন্নত করিতে হয়, তবে বাঙ্গালা দেশের কথা লইয়াই সাহিত্য গড়িতে হইবে। প্রকৃত পক্ষে আমাদের জাতীয় সাহিত্যের আদি “আলালের ঘরের দুলাল"। প্যারীচাঁদ মিত্রের এই দ্বিতীয় অক্ষয়-কীর্ত্তি।
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বাঙ্গালা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্র, বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রকাশক- শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬১ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮৬৩
- ১৮৪৪ সালে দুইটী ঘটনা ঘটে। প্রথম, বর্ত্তমান মেটকাফ হলের নির্ম্মাণকার্য্য শেষ হইলে পাবলিক লাইব্রেরী সেই ভবনে উঠিয়া আসে। নব্যবঙ্গের অন্যতম নেতা প্যারীচাঁদ মিত্র মহাশয় উহার লাইব্রেরীয়ান নিযুক্ত হওয়াতে লাইব্রেরিটী রামগোপাল ঘোষ, তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তী, রামতনু লাহিড়ী প্রভৃতি যুবকদলের একটা সম্মিলন ও জ্ঞানালোচনার ক্ষেত্র হইয়া উঠে।
- শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রকাশসাল- ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৭১
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনাউইকিপিডিয়ায় প্যারীচাঁদ মিত্র সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ রয়েছে।
উইকিসংকলনে প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত অথবা সম্পর্কিত রচনা রয়েছে।
উইকিমিডিয়া কমন্সে প্যারীচাঁদ মিত্র সংক্রান্ত মিডিয়া রয়েছে।