বাঁশি

বাদ্যযন্ত্র

বাঁশি হলো এক ধরনের সুষির অর্থাৎ ফুৎকার (ফুঁ) দিয়ে বাজানো যায় এমন বাদ্যযন্ত্র। বাংলায় বাঁশিকে মুরালি, মোহন বাঁশি, বংশী অথবা বাঁশরিও বলা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঁশি তৈরিতে তরলা বাঁশ ব্যবহার করা হয়। তবে শখের বশে বিভিন্ন ধাতু যেমন ইস্পাত, তামা, পিতল, রূপো এমনকি সোনার নল দিয়েও বাঁশি তৈরীর কথা জানা যায়। যে নল দিয়ে বাঁশি তৈরি করা হয় তার এক প্রান্ত সম্পূর্ণ আটকে বায়ুরোধী করা হয়। অন্য খোলা প্রান্তের মাঝামাঝি স্থানে বাঁশির ছিদ্রগুলি করা হয়। কয়েক হাজার বছর ধরে বাঁশি বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। পৌরাণিক কাহিনীতেও বাঁশির উল্লেখ রয়েছে।

প্রাণ-উদাসী
বাঁশের বাঁশি
মোহন সুরে বাজে রে,
মোহন সুরে বাজে।
সুনির্মল বসু
  • পথের ধারে দাঁড়িয়ে বাঁশি শুনি আর মন যে কেমন করে বুঝতে পারি নে। সেই ব্যথাকে চেনা সুখ-দুঃখের সঙ্গে মেলাতে যাই, মেলে না। দেখি, চেনা হাসির চেয়ে সে উজ্জ্বল, চেনা চোখের জলের চেয়ে সে গভীর।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঁশি, লিপিকা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- ইণ্ডিয়ান প্রেস লিমিটেড, প্রকাশস্থান- এলাহাবাদ, প্রকাশসাল- ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ (১৩২৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৫
  • প্রাণ-উদাসী
    বাঁশের বাঁশি
    মোহন সুরে বাজে রে,
    মোহন সুরে বাজে।
    • সুনির্মল বসু, বাঁশের বাঁশি, সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা- সুনির্মল বসু, প্রকাশক- মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩০
  • বেসুরে কি এ বাঁশী বাজে? বাঁশী বাজি বাজি করে, তবু বাজে না—বাঁশী ফাটিয়াছে। আবার বাজ দেখি, হৃদয়ের বংশী! হায়! তুই কি আর তেমনি করিয়া বাজিতে জানিস্? তার কি সে তান মনে আছে? না, তুই সেই আছিস্—না আমি সেই আমি আছি। তুই ঘুণে ধরা বাঁশী—আমি ঘুণে ধরা—আমি ঘুণে ধরা কি ছাই তা আমি জানি না। আমার সে স্বর নাই —আর বাজাইব কি?
    • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কমলাকান্তের বিদায়, কমলাকান্তের পত্র, কমলাকান্ত - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ (১২৯২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২১৮
  • ইংরাজ রাজত্বের রেলের বাঁশি, স্টিমারের বাঁশি, কারখানার বাঁশি চারি দিকে বাজিয়া উঠিয়াছে— চারি দিকে আপিস-ঘর, আদালত-ঘর, থানাঘর মাথা তুলিতেছে; ইংরাজের নূতন চুনকাম-করা ফিট্‌ফাট ধব্‌ধবে প্রতাপ দেশ জুড়িয়া ভিত্তি গাড়িয়াছে— কোথাও বিচ্ছেদ নাই।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুর্শিদাবাদ-কাহিনী, গ্রন্থ-সমালোচনা, ইতিহাস-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৫২-১৫৩
  • সাপ খেলানোয় নতুনত্ব কিছু নেই, সেই গেরুয়া আলখাল্লা পরা সাপুড়ে, সেই ঝাঁপি, সেই একটানা সুরের বাঁশী। তবু সাপ খেলানো কখনো পুরানো হয় না, কখনো একঘেয়ে লাগে না। কেবল ঝাঁপির মুখ বন্ধ করে সাপুড়ে যখন বাঁশী বাজাতে বাজাতে চলে যায় তখন মনে হয় জীবনের বড় একটা উত্তেজক ঘটনা যেন শেষ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ মনটা অধীর হয়ে থাকে, ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
    • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নবম পরিচ্ছেদ, প্রকাশক- ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮০-৮১
  • সে বালিকার এই প্রলয় মুর্ত্তি দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। কহিল “চারু, আমার বাঁশিটা ভাঙ্গ্‌চ কেন?” চারু রক্তনেত্রে রক্তিমমুখে “বেশ কর্‌চি, খুব কর্‌চি” বলিয়া আরও বার দুই চার বিদীর্ণ বাঁশির উপর অনাবশ্যক পদাঘাত করিয়া উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে কাঁদিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। তারাপদ বাঁশিটি তুলিয়া উল্টিয়া পাল্টিয়া দেখিল তাহাতে আর পদার্থ নাই। অকারণে, তাহার পুরাতন নিরপরাধ বাঁশিটার এই আকস্মিক দুর্গতি দেখিয়া সে আর হাস্য সম্বরণ করিতে পারিল না।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতিথি, চতুর্থ পরিচ্ছেদ, গল্প-দশক - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশসাল- ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩০২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২০৭-২০৮
  • নীরবে নিবিড় নীড়ে সে যায়—
    বাঁশী ধ্বনি আজি নিকুঞ্জ বনে?
    হায়, ও কি আর গীত গাইছে?
    না হেরি শ্যামে ও বাঁশী কাঁদিছে?
    • মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বংশী ধ্বনি, ব্রজাঙ্গনা কাব্য - মাইকেল মধুসূদন দত্ত, প্রকাশসাল- ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ (১২৭১ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৪
  • যার লাগি ফিরি একা একা— আঁখি পিপাসিত, নাহি দেখা,
    তারি বাঁশি ওগো তারি বাঁশি তারি বাঁশি বাজে হিয়া ভরি মরি মরি।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাগরণে যায় বিভাবরী, ক্ষণিকা, গীতবিতান-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ (১৪০০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৮৭
  • কি করিব রাজ রাজত্বে হইলাম উদাসী।
    ঘরে থাকতে না দেয় মন আমার পাগল করা বাঁশী॥
    আমার হাতের বাঁশী রাজা আমার হইল বৈরী।
    কি করিব মনের বাঁশী ছাইড়া গেলে মরি॥
    বাঁশী আমার জীবন মরণ বাঁশী আমার প্রাণ।
    মরণ জিওন ধরম করম ঐনা বাঁশীর গান॥
    • অজ্ঞাত, আঁধাবন্ধু, পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা - দীনেশচন্দ্র সেন, চতুর্থ খণ্ড, প্রকাশক- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা, প্রকাশসাল- ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৯৮
  • তাহার কথা শুনিয়া অবাক্‌ হইয়া গেলাম—তুমি সাপ খেলাবে কি? কামড়ায় যদি? ইন্দ্র উঠিয়া গিয়া ঘরে ঢুকিয়া একটা ছোট ঝাঁপি এবং সাপুড়ের বাঁশি বাহির করিয়া আনিল; এবং সুমুখে রাখিয়া ডালার বাঁধন আল্‌গা করিয়া বাঁশিতে ফুঁ দিল। আমি ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া উঠিলাম।
    • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত (প্রথম পর্ব), দশম পরিচ্ছেদ, শ্রীকান্ত (প্রথম পর্ব)-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক-গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, সপ্তদশ মুদ্রণ, পৃষ্ঠা ৫৯
  • কুঞ্জবনের ভ্রমর বুঝি
    বাঁশির মাঝে গুঞ্জরে,
    বকুল গুলি আকুল হয়ে
    বাঁশির গানে মুঞ্জরে।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঁশি, কড়ি ও কোমল-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশসাল- ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ (১২৯৩ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৭৩
  • তাই উন্মনা আমি তৃষিত নয়নে
    দুয়ারে ছুটিয়া আসি;—
    ওগো গগনে, পবনে, পরাণে আমার
    নিয়ত বাজিছে বাঁশী!
    • সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, বাঁশী, ফুলের ফসল - সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, তৃতীয় সংস্করণ, প্রকাশক- ইণ্ডিয়ান্ প্রেস লিমিটেড, এলাহাবাদ, পৃষ্ঠা ২৫
  • তুমি ভেবো না। এই বাঁশীটা নাও।” বলে বুড়ী টুপীর ভেতর থেকে একটা হাতীর দাঁতের বাঁশী বের করে রাখালের হাতে দিলে। সুন্দর বাঁশী, দুধের মত রং। বাঁশী হাতে নিয়ে মুখ তুলতেই রাখাল দেখলে বুড়ী আর নেই। রাখাল খানিকক্ষণ “বুড়ী” “বুড়ী” ক’রে ডাকল। কেউ সাড়া দিল না। বাঁশী দিয়ে কি করতে হবে ভেবে না পেয়ে রাখাল ধীরে ধীরে ফিরে গেল। সমস্ত দিনের পরিশ্রমে আর অনাহারে ক্লান্ত হ’য়ে সে বাঁশী হাতে করে ঘুমিয়ে পড়ল।
    • রবীন্দ্রনাথ মৈত্র, মায়াবাঁশী, মায়াবাঁশী - রবীন্দ্রনাথ মিত্র, প্রকাশক- ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪
  • সবার চেয়ে আনন্দময়
    ওই মেয়েটির হাসি—
    এক পয়সায় কিনেছে ও
    তালপাতার এক বাঁশি।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুখদুঃখ, ক্ষণিকা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ (১৪০০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৬০
  • কিছুক্ষণ থেকে সাপুড়ের বাঁশীর আওয়াজ কাণে আসছিল, নিতাই চলে গেলে নাগা লঞ্চ থেকে নেমে সাপ খেলানো দেখতে গেল। একটা দোকানের সামনে সাপুড়েকে ঘিরে ভিড় জমেছে আর ভিড়ের ঠিক সামনেই দাড়িয়ে আছে পঞ্চ।
    • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নবম পরিচ্ছেদ, প্রকাশক- ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮০
  • উদাস বাঁশী
    করিল উদাসী
    বিমনা যে গৃহকাজে।
    সরম ভরম
    সকলি গেল যে
    কুলবালার কি তা’ সাজে।
    ঐ বাজে মুরলী বাজে॥
    • সারদাপ্রসাদ ঠাকুর, মুরলী রবে, মুরলী-সারদাপ্রসাদ ঠাকুর, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ (১৩২৩ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২১
  • বালককালে বাঁশির উপরে দখল ছিল না; বাজিয়েছিলেম যেমন-তেমন করে, পথে লোক জড়ো হয় নি। তার পরে যৌবনে বাঁশিতে সুর লাগল বলে যখন নিজের মনে সন্দেহ রইল না, তখন সকলকে নিঃসংকোচে বলেছি ‘তোমরা শোনো।’
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সম্মান, আত্মপরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ২০১০ খ্রিস্টাব্দ (১৪১৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১১৮
  • বাঁশীটি খুয়ে কানাই নামে হাঁটু জলে
    নেতের অঞ্চল দিয়া রাধা বাঁশী চুরি করে।
    বাঁশীটি হারায়ে কানাই ভাবে মনে মন
    এমন সুরে বাঁশী নিল কোন জন।
    বাঁশীটি হারায়ে কানাই যায়রে গোয়াল পাড়া
    ঘরে ঘরে জিজ্ঞাসা করে তোমারা এ বাঁশী চোরা।
    • অজ্ঞাত, রাধার বারোমাসী, হারামণি, সম্পাদনা- মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশসাল- ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১২৬

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা