বাল্মীকিপ্রতিভা
বাল্মীকি-প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একটি গীতিনাট্য। ১৮৮১ সালে প্রকাশিত এই নাটকটি রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম নাট্যসাহিত্য। ১৮৮১ সালেই প্রথম মঞ্চায়িত হয় এই নাটক। বাল্মীকি-প্রতিভা –র আখ্যানবস্তু কৃত্তিবাসি রামায়ণ থেকে গৃহীত। নাটকের আঙ্গিকে ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সুর নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছে। এই নাটকের হাত ধরেই বাংলায় গীতিনাট্য ঐতিহ্যের সূচনা হয়। বাল্মীকি-প্রতিভা রচনার অব্যবহিত পরে এর সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ কালমৃগয়া নামক আর একটি গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন।
উক্তি
সম্পাদনা- “প্রথম দস্যু। আজকে তবে মিলে সবে কর্ব লুঠের ভাগ,
এসব আন্তে কত লণ্ডভণ্ড করনু যজ্ঞ যাগ।
দ্বিতীয় দস্যু। কাজের বেলায় উনি কোথা যে ভাগেন্, ভাগের বেলায় আসেন আগে আরে দাদা!
প্রথম। এত বড় আস্পর্দ্ধা তোদের, মোরে নিয়ে একি হাসি তামাসা? এখনি মুণ্ড করিব খণ্ড-- খবরদার রে খবরদার!
দ্বিতীয়। হাঃ হাঃ ভায়া খাপ্পা বড়, এ কি ব্যাপার! আজি বুঝিবা বিশ্ব করবে নস্য এম্নি যে আকার!
তৃতীয়। এম্নি যোদ্ধা উনি পিঠেতেই দাগ-- তলোয়ার মরিচা, মুখেতেই রাগ।
প্রথম। আর যে এসব সহে না প্রাণে, নাহি কি তোদের প্রাণের মায়া? দারুণ রাগে কাঁপিছে অঙ্গ, কোথা রে লাঠি কোথা রে ঢাল?
সকলে। হাঃ হাঃ ভায়া খাপ্পা বড়, এ কি ব্যাপার! আজি বুঝিবা বিশ্ব করবে নস্য এমনি যে আকার!
সকলে। এক ডোরে বাঁছা আছি মোরা সকলে। না মানি বারণ, না মানি শাসন, না মানি কাহারে। কেবা রাজা কার রাজ্য মোরা কি জানি? প্রতি জনেই রাজা মোরা, বনই রাজধানী! রাজা প্রজা, উঁচু নীচু, কিছু না গণি! ত্রিভুবনমাঝে আমরা সকলে কাহারে না করি ভয়-- মাথার উপরে রয়েছেন কালী, সমুখে রয়েছে জয়!” — বাল্মীকি প্রতিভা, প্রথম দৃশ্য।
- “বাল্মীকি। রাঙাপদপদ্মযুগে প্রণমি গো ভবদারা !
আজি এ ঘোর নিশীথে পূজিব তোমারে তারা। সুরনর থরহর– ব্রহ্মাণ্ডবিপ্লব করো , রণরঙ্গে মাতো , মা গো , ঘোরা উন্মাদিনী - পারা। ঝলসিয়ে দিশি দিশি ঘুরাও তরিত - অসি , ছুটাও শোণিতস্রোত , ভাসাও বিপুল ধরা। উরো কালী কপালিনী , মহাকালসীমন্তিনী , লহো জবাপুষ্পাঞ্জলি মহাদেবী পরাৎপরা।।!
দস্যুগণ। দেখ, হো ঠাকুর, বলি এনেছি মোরা। বড় সরেস, পেয়েছি বলি সরেস, এমন সরেস মছ্লি রাজা জালে না পড়ে ধরা! দেরি কেন ঠাকুর, সেরে ফেল' ত্বরা!
বাল্মীকি। নিয়ে আয় কৃপাণ, হয়েছে তৃষিতা শ্যামা মা, শোণিত পিয়াও, যা ত্বরায়! লোল জিহ্বা লকলকে, তড়িত খেলে চোখে, করিয়ে খণ্ড দিক্ দিগন্ত ঘোর দন্ত ভায়!
বালিকা। কি দশা হ'ল আমার, হায়! কোথা গো মা করুণাময়ী, অরণ্যে প্রাণ যায় গো! মুহূর্তের তরে, মা গো, দেখা দেও আমারে-- জনমের মত বিদায়!
বাল্মীকি। এ কেমন হ'ল মন আমার! কি ভাব এ যে কিছুই বুঝিতে যে পারি নে! পাষাণ হৃদয়ো গলিল কেন রে, কেন আজি আঁখিজল দেখা দিল নয়নে! কি মায়া এ জানে গো, পাষাণের বাঁধ এ যে টুটিল, সব ভেসে গেল গো-- সব ভেসে গেল গো-- মরুভূমি ডুবে গেল করুণার প্লাবনে!” — বাল্মীকি প্রতিভা, দ্বিতীয় দৃশ্য।
- “প্রথম দস্যু। রাজা মহারাজা কে জানে,আমিই রাজাধিরাজ।
তুমি উজীর,কোতোয়াল তুমি, ওই ছোঁড়াগুলো বরকন্দাজ। যত সব কুঁড়ে আছে ঠাঁই জুড়ে কাজের বেলায় বুদ্ধি যায় উড়ে। পা ধোবার জল নিয়ে আয় ঝট্, কর্ তোরা সব যে যার কাজ।
দ্বিতীয় দস্যু। আছে তোমার বিদ্যে-সাধ্যি জানা। রাজত্ব করা এ কি তামাশা পেয়েছ।
প্রথম দস্যু। জানিস না কেটা আমি।
দ্বিতীয় দস্যু। ঢের ঢের জানি-- ঢের ঢের জানি--
প্রথম দস্যু। হাসিস নে হাসিস নে মিছে,যা যা-- সব আপন কাজে যা যা, যা আপন কাজে।
দ্বিতীয় দস্যু। খুব তোমার লম্বাচওড়া কথা! নিতান্ত দেখি তোমায় কৃতান্ত ডেকেছে!
তৃতীয় দস্যু। আঃ কাজ কী গোলমালে, না হয় রাজাই সাজালে। মরবার বেলায় মরবে ওটাই,থাকব ফাঁকতালে।
প্রথম দস্যু। রাম রাম হরি হরি,ওরা থাকতে আমি মরি! তেমন তেমন দেখলে বাবা ঢুকব আড়ালে।
সকলে। ওরে চল্ তবে শিগ্গিরি, আনি পূজোর সামিগ্গিরি। কথায় কথায় রাত পোহাল,এমনি কাজের ছিরি।” — বাল্মীকি প্রতিভা, তৃতীয় দৃশ্য।
- “বাল্মীকি। অহো আস্পর্ধা এ কী তোদের নরাধম!
তোদের কারেও চাহি নে আর আর না রে-- দূর দূর দূর,আমারে আর ছুঁস নে। এ-সব কাজ আর না,এ পাপ আর না, আর না আর না, ত্রাহি,সব ছাড়িনু!
প্রথম দস্যু। দীন হীন এ অধম আমি কিছুই জানি নে রাজা। এরাই তো যত বাধালে জঞ্জাল, এত করে বোঝাই বোঝে না। কী করি দেখো বিচারি।
দ্বিতীয় দস্যু। বাঃ-- এও তো বড়ো মজা, বাহবা! যত কুয়ের গোড়া ওই তো,আরে বল্ না রে।
প্রথম দস্যু। দূর দূর দূর,নির্লজ্জ আর বকিস নে।
বাল্মীকি। তফাতে সব সরে যা। এ পাপ আর না, আর না,আর না,ত্রাহি,সব ছাড়িনু।” — বাল্মীকি প্রতিভা,তৃতীয় দৃশ্য।
- “প্রথম দস্যু। প্রাণ নিয়ে ত সট্কেছি রে করবি এখন কী।
ওরে বরা করবি এখন কী। বাবা রে,আমি চুপ করে এই কচুবনে লুকিয়ে থাকি। এই মরদের মুরদখানা,দেখেও কি রে ভড়কালি না, বাহবা শাবাশ তোরে, শাবাশ রে তোর ভরসা দেখি।
অন্য দস্যু। বলব কী আর বলব খুড়ো-- উঁ উঁ। আমার যা হয়েছে বলি কার কাছে-- একটা বুড়ো ছাগল তেড়ে এসে মেরেছে ঢুঁ।
প্রথম দস্যু। তখন যে ভারি ছিল জারিজুরি, এখন কেন করছ বাপু উঁ উঁ উঁ-- কোন্খানে লেগেছে বাবা,দিই একটু ফুঁ।” — বাল্মীকি প্রতিভা, চতুর্থ দৃশ্য।
- “দস্যুগণ। সর্দার মহাশয় দেরি না সয়,
তোমার আশায় সবাই বসে। শিকারেতে হবে যেতে, মিহি কোমর বাঁধো কষে। বনবাদাড় সব ঘেঁটে ঘুঁটে, আমরা মরব খেটে খুটে, তুমি কেবল লুটে পুটে পেট পোরাবে ঠেসে ঠুসে।
প্রথম দস্যু। কাজ কী খেয়ে তোফা আছি, আমায় কেউ না খেলেই বাঁচি, শিকার করতে যায় কে মরতে, ঢুঁসিয়ে দেবে বরা মোষে। ঢুঁ খেয়ে তো পেট ভরে না-- সাধের পেটটি যাবে ফেঁসে।” — বাল্মীকি প্রতিভা, চতুর্থ দৃশ্য।
- “বাল্মীকি। রাখ্ রাখ্ ফেল্ ধনু ছাড়িস নে বাণ।
হরিণ-শাবক দুটি প্রাণভয়ে ধায় ছুটি, চাহিতেছে ফিরে ফিরে করুণ নয়ান। কোনো দোষ করে নি তো সুকুমার কলেবর, কেমনে কোমল দেহে বিঁধিবি কঠিন শর। থাক্ থাক্ ওরে থাক্,এ দারুণ খেলা রাখ্, আজ হতে বিসর্জিনু এ ছার ধনুক বাণ।
দস্যুগণ। আর না আর না,এখানে আর না, আয় রে সকলে চলিয়া যাই। ধনুক বাণ ফেলেছে রাজা, এখানে কেমনে থাকব ভাই! চল্ চল্ চল্ এখনি যাই।
দস্যুগণ। তোর দশা, রাজা, ভালো তো নয়, রক্তপাতে পাস রে ভয়, লাজে মোরা মরে যাই। পাখিটি মারিলে কাঁদিয়া খুন, না জানি কে তোরে করিল গুণ, হেন কভু দেখি নাই।” — বাল্মীকি প্রতিভা, চতুর্থ দৃশ্য।
- “প্রথম ব্যাধ। দেখ্ দেখ্, দুটো পাখি বসেছে গাছে।
দ্বিতীয় ব্যাধ। আয় দেখি চুপি চুপি আয় রে কাছে।
প্রথম ব্যাধ। আরে ঝট্ করে এই বারে ছেড়ে দে রে বাণ।
দ্বিতীয় ব্যাধ। রোস রোস আগে আমি করি রে সন্ধান।
বাল্মীকি। থাম্ থাম্,কী করিবি বধি পাখিটির প্রাণ। দুটিতে রয়েছে সুখে,মনের উল্লাসে গাহিতেছে গান।
প্রথম ব্যাধ। রাখো মিছে ও-সব কথা, কাছে মোদের এস নাকো হেথা, চাই নে ও-সব শাস্তর কথা, সময় বহে যায় যে।
বাল্মীকি। শোনো শোনো মিছে রোষ ক'রো না।
ব্যাধ। থামো থামো ঠাকুর, এই ছাড়ি বাণ।
বাল্মীকি। মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ, যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্। কী বলিনু আমি! এ কী সুললিত বাণী রে! কিছু না জানি কেমনে যে আমি প্রকাশিনু দেবভাষা, এমন কথা কেমনে শিখিনু রে! পুলকে পুরিল মনপ্রাণ,মধু বরষিল শ্রবণে, এ কী! হৃদয়ে এ কী এ দেখি!-- ঘোর অন্ধকার মাঝে,এ কী জ্যোতি ভায়, অবাক্!-- করুণা এ কার!
বাল্মীকি। এ কী এ, এ কী এ, স্থির চপলা! কিরণে কিরণে হল সব দিক উজলা! কী প্রতিমা দেখি এ, জোছনা মাখিয়ে, কে রেখেছে আঁকিয়ে, আ মরি কমল-পুতলা!” — বাল্মীকি প্রতিভা, পঞ্চম দৃশ্য।
- “বাল্মীকি। কোথা লুকাইলে?
সব আশা নিবিল, দশদিশি অন্ধকার, সবে গেছে চলে ত্যেজিয়ে আমারে, তুমিও কি তেয়াগিলে।
লক্ষ্মী। কেন গো আপন মনে ভ্রমিছ বনে বনে,সলিল দু-নয়নে কিসের দুখে? কমলা দিতেছি আসি,রতন রাশি রাশি,ফুটুক তবে হাসি মলিন মুখে। কমলা যারে চায়,বলো সে কী না পায়,দুখের এ ধরায় থাকে সে সুখে। ত্যেজিয়া কমলাসনে,এসেছি ঘোর বনে, আমারে শুভক্ষণে হেরো গো চোখে।
বাল্মীকি। কোথায় সে উষাময়ী প্রতিমা। তুমি তো নহ সে দেবী, কমলাসনা, ক'রো না আমারে ছলনা। কী এনেছ ধন মান, তাহা যে চাহে না প্রাণ দেবী গো,চাহি না চাহি না,মণিময় ধূলিরাশি চাহি না, তাহা লয়ে সুখী যারা হয় হোক,হয় হোক-- আমি,দেবী,সে সুখ চাহি না। যাও লক্ষ্মী অলকায়,যাও লক্ষ্মী অমরায়, এ বনে এসো না এসো না, এসো না এ দীনজন-কুটিরে। যে বীণা শুনেছি কানে,মন প্রাণ আছে ভোর, আর কিছু চাহি না চাহি না।” — বাল্মীকি প্রতিভা, ষষ্ঠ দৃশ্য।