স্বর্ণকুমারী দেবী
স্বর্ণকুমারী দেবী (২৮ আগস্ট ১৮৫৫ – ৩ জুলাই ১৯৩২) ছিলেন একজন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতকার ও সমাজ সংস্কারক। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তিনিই ছিলেন প্রথম উল্লেখযোগ্য মহিলা সাহিত্যিক। স্বর্ণকুমারী ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্রী এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা। তিনি তার অনুজ ভ্রাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো ছিলেন। ১৮৭৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস দীপনির্বাণ প্রকাশিত হয়। তিনিই ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক। স্বর্ণকুমারী একাধিক উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেন। তিনি দীর্ঘ কয়েক বছর ভারতী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তার রচিত উপন্যাসগুলি হলো দীপনির্বাণ, মিবাররাজ, ছিন্নমুকুল, মালতী, হুগলীর ইমামবাড়ি, বিদ্রোহ, স্নেহলতা বা পালিতা, কাহাকে, ফুলের মালা, বিচিত্রা, স্বপ্নবাণী, মিলনরাত্রি, সাব্বিরের দিন রাত প্রভৃতি। তার রচিত নাটকগুলি হলো বিবাহ-উৎসব, বসন্ত-উৎসব, রাজকন্যা, দিব্যকমল, দেবকৌতুক, কনেবদল, যুগান্ত এবং নিবেদিতা। তিনি গাথা এবং গীতিগুচ্ছ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। স্বর্ণকুমারী দেবী তিন শতাধিক গানের রচয়িতা। ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের মধ্যে গান রচনার সংখ্যার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর স্বর্ণকুমারীর স্থান।
উক্তি
সম্পাদনা- সত্যনিষ্ঠা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম্মনীতি, কারণ যাহা ন্যায় তাহাই সত্য, যাহা পুণ্য তাহাই সত্য, আর যাহা অন্যায় যাহা পাপ তাহাই মিথ্যা।
- সত্য, গল্পস্বল্প- স্বর্ণকুমারী দেবী, চতুর্থ সংস্করণ, প্রকাশসাল- ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ (১৩০০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৪
- তুমি যদি অন্যের নিকট ক্ষমা পাইতে চাহ তবে অন্যকে ক্ষমা করিতে শিখ। যদি শত্রুকেও মিত্র করিতে চাও তবে উপকার করিয়া তৎকৃত অপকারের প্রতিশোধ প্রদান কর।
- ক্ষমা, গল্পস্বল্প- স্বর্ণকুমারী দেবী, চতুর্থ সংস্করণ, প্রকাশসাল- ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ (১৩০০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪০
- যে সকল জ্যোতিষ্ককে মধ্যে মধ্যে আমরা খসিয়া পড়িতে দেখি তাহাদের সাধারণ নাম উল্কাপিণ্ড। সচরাচর আমরা ইহাকে তারা খসা বলি। উল্কাপিণ্ডের মধ্যে আবার একটি বিশেষ দল (Zodiacal light) সূর্য্যের চারি দিকে ঘুরিতেছে। প্রতি বৎসর শরদাগমে অধিক সংখ্যায় আমরা উল্কাপাত দেখিতে পাই। ইহাদের সবিশেষ তথ্য এখনো আমরা অবগত নহি।
- পৃথিবী - স্বর্ণকুমারী দেবী, প্রকাশক- আদি ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্র, প্রকাশস্থান- কলকাতা, মুদ্রক- আদি ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্র, প্রকাশসাল- ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ (১২৮৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৪
- আমি সন্ধ্যা পৃথিবীর অতি দীন হীন,
নাহি গুণ, রূপ-রাশি
ভুলিয়ে যদি বা হাসি
বিষাদ অশ্রুর জলে তাহাও মলিন।- সন্ধ্যার স্মৃতি, কবিতা ও গান - স্বর্ণকুমারী দেবী, প্রকাশক ও মুদ্রক - “ভারতী যন্ত্র”, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩০২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫৬
- সকলে মিলিয়া আনন্দ-রব করিতে করিতে শিকারে গমন করিল। অরণ্যে প্রবেশ করিয়া গাছের ডাল ভাঙ্গিয়া, পাতা ছিঁড়িয়া, পাখী মারিয়া, পশু মারিয়া, ভয়বিহ্বল পলাতক পশুদিগের পশ্চাৎধাবিত হইয়া অরণ্য তোলপাড় করিতে লাগিল। এই সুপ্রভাতে অরণ্যবাসী নিরীহ পশু পক্ষীদিগের আকুল ক্রন্দন আর শিকারীদিগের পৈশাচিক উন্মত্ত চীৎকার ধ্বনি যতদুর গেল—বিদীর্ণ করিয়া তুলিল, কেবল মতি অরণ্য মহাকালের মত উদাস ভাবে এই সুখ দুঃখের প্রতি অবিচলিত দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল, —তাহার প্রাণে সে হাসি কান্না বিন্দুমাত্র স্পর্শ করিল না।
- মিবাররাজ, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, মিবাররাজ-স্বর্ণকুমারী দেবী, মুদ্রক- আদি ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্র, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দ (১২৯৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪-৫
- অন্যকে ভালবাসিতে পারিলে ক্ষমা করা অতি সহজ। আমরা আপনার লোকদিগকে ভালবাসি তাই তাহাদিগকে সর্ব্বদাই ক্ষমা করিয়া থাকি। যাঁহারা মহৎ লোক তাঁহারা পরকেও আপনার মত ভালবাসেন, তাই শত্রুকেও তাঁহারা ক্ষমা করেন,—অপকারীর উপকার করিয়া তাঁহারা তাহার প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। ইহাই যথার্থ প্রতিশোধ, কেন না এইরূপ প্রতিশোধে শত্রুও মিত্র হয়।
- ক্ষমা, গল্পস্বল্প- স্বর্ণকুমারী দেবী, চতুর্থ সংস্করণ, প্রকাশসাল- ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ (১৩০০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪০
- বেড়াইতে বেড়াইতে দেখিল, বাগানের এই নানা রকম সুগন্ধ সুদৃশ্য অপরিচিত পুষ্পবৃক্ষের এক পাশে একটি গোলাপের গাছ, সেই গাছে একটি সুন্দর প্রস্ফুটিত গোলাপ। লাবণ্য সেই গোলাপটি তুলিতে হাত বাড়াইল! এই সময় সহসা কোথা হইতে পূর্ব্বেকার পরীটি আসিয়া বলিলেন, “ইহা তুলিও না, ঐ দেখ কত ধৈর্য্য ফুল ফুটিয়া রহিয়াছে—উহার একটি তোল, গোলাপ অপেক্ষা দেখ ঐ ফুলগুলি কত সুন্দর।
- সুবুদ্ধির উপদেশ, গল্পস্বল্প- স্বর্ণকুমারী দেবী, চতুর্থ সংস্করণ, প্রকাশসাল- ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ (১৩০০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৯-১০
- বায়ু বহে মৃদু মন্দ, মধুর চাঁপার গন্ধ
পাতার বিতান হতে আসে ভেসে ভেসে।- সন্ধ্যা, গল্পস্বল্প- স্বর্ণকুমারী দেবী, চতুর্থ সংস্করণ, প্রকাশসাল- ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ (১৩০০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৭৩
- সবিস্ময়ে সে চারিদিকে চাহিয়া দেখিল,—সে পরী নাই, সে বাগান নাই—সে কিছুই আর নাই, তাহা অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর আর একটি বাগানে সে একাকী আসিয়া পড়িয়াছে। কি চমৎকার বাগান। এমন বাগান সে জন্মে কখনও দেখে নাই। এ কি নন্দন কানন? দিদিমার কাছে লাবণ্য স্বর্গের যে নন্দন কাননের গল্প শুনিয়াছে, এ কি সেই কানন! বাগান আলো করিয়া গাছে গাছে কি সুন্দর ফুল ফুটিয়া আছে!
- সুবুদ্ধির উপদেশ, চতুর্থ সংস্করণ, প্রকাশসাল- ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ (১৩০০ বঙ্গাব্দ), গল্পস্বল্প- স্বর্ণকুমারী দেবী, পৃষ্ঠা ৯